GUIDELINES
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র — স্থানীয় উদ্যোগে শিক্ষা
শিশুদের লেখাপড়া শেখানোয় গ্রামের মা-মাসি-দিদিদের স্থানীয় উদ্যোগ
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র কোনও প্রতিষ্ঠান, ইস্কুল, কোচিং সেন্টার, বা সংস্থা নয়, এক ভাবনা ও তার পরিকল্পনা। শিশুশিক্ষায় সহায়তা করতে যে কেউ তার নিজের মতো করে এই উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে এই উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনও সংস্থা গড়ে সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় অনেকের ব্যক্তি-উদ্যোগ ও মিলিত সহায়তাই কাম্য। সে ছাড়া, কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতার জোয়াল কাঁধে নিয়ে এর সার্থক রূপায়ণ সম্ভবও নয়।
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র কীভাবে শুরু করা

শিশুশিক্ষার এই পরিকল্পনার মূল কথা হল, বাইরে থেকে আসা শিক্ষক নয়, গ্রামেরই কোনও মোটামুটি লেখাপড়া জানা (মাধ্যমিক হলেও চলবে) স্থানীয় গৃহবধূ বা মেয়ে মা-মাসি-দিদির মতো যত্ন করে শিশুদের হাতেখড়ি থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া শিখতে সাহায্য করবেন মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষায়। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র ইস্কুল শিক্ষার বিকল্প নয়, তাকে সহজ ও বোধগম্য করার সহায়ক। এর জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান, আলাদা বাড়িঘর গড়া নিষ্প্রয়োজন।
এই পরিকল্পনা রূপায়ণে উদ্যোগ নিতে প্রথমেই প্রয়োজন হবে কোনও গ্রামের সাথে সরাসরি বা কারো মারফৎ যোগাযোগ। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনা করে উদ্যোক্তা গ্রামেরই কোনও মহিলা বা মেয়েকে দিদিমণি হিসাবে নিয়োজিত করবেন শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্বে। এই দায়িত্ব পালনে দিদিমণিকে কী কী করতে হবে তার কিছু নির্দেশিকা স্থির করা আছে (দিদিমণিদের জন্য কিছু কথা)। সেইগুলি দিদিমণিকে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে। কীভাবে কী কী শেখাতে হবে তা আলোচনা করে শিক্ষণ পদ্ধতির রূপরেখা ও সেইমতো পাঠ সংকলনগুলো দিদিমণিকে বুঝিয়ে দিতে হবে।


গ্রামের এই শিক্ষাকেন্দ্রটি চালু করতে উদ্যোক্তাকে কিছু আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে— প্রারম্ভিক আয়োজনে এককালীন ২০০০-২৫০০ টাকা ও প্রতি মাসে ১০০০ টাকা দিদিমণির সাম্মানিক, যা সরাসরি দিদিমণির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হবে। তৃতীয়ত, উদ্যোক্তা নিয়মিত দিদিমণির সাথে যোগাযোগ রাখবেন, শিশুদের লেখাপড়ায় অগ্রগতি কেমন হচ্ছে, কোনও অসুবিধা আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নেবেন, ও সুযোগসুবিধা মতো স্থানীয় মানুষ ও অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করবেন এই উদ্যোগকে স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে রূপায়িত করতে।
দিদিমণিদের জন্য কিছু কথা

গ্রামবাসী ও দিদিমণিদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলতে হবে বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের কাজটা ঠিক কী, দিদিমণিকে কী করতে হবে, তাঁর কী দায়িত্ব, কোন্ শিশুদের নেওয়া হবে, কীভাবে কী শেখাতে হবে, রোজকার পঠনপাঠন কীভাবে হবে ইত্যাদি বিষয়। তার সাথে নির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে বিদ্যাচর্চার কাজে ন্যূনতম আয়োজন হিসাবে বইপত্র, খাতা-পেনসিল ইত্যাদি ও দিদিমণিদের জন্য কিছু মাসিক সাম্মানিকের ব্যবস্থা কীভাবে করা হবে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য রাখা আছে ‘দিদিমণিদের জন্য কিছু কথা’।
কী কী শেখাতে হবে ৩–৭ বছর
৩ থেকে ৭ হল ৪ বছর সময় — প্রাক্-প্রাথমিক (৩+) থেকে ইস্কুলে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত (৬+)। একেবারে কচিকাঁচাদের এই ৪ বছর সময় রাখা — ছটফট না করে এক জায়গায় বসতে শেখা, অল্প অল্প করে শুরু করা, খেলাধূলা, ছবি আঁকা, ছড়া বলা, মাঝেমধ্যে পড়তে না-আসা, ইত্যাদি সবের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের ইস্কুলে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি থেকেই বাংলা, অঙ্ক, ও ইংরেজি শেখানো শুরু হয়ে যায়। এইসব কথা মাথায় রেখেই এই পর্যায়ের বুনিয়াদী পাঠগুলো সাজানো হয়েছে চারটি ধাপে দুটি ছোট পুস্তিকায়, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে ভাগ করে। ৬-৭ বছর বা আরও বড় বয়েসের শিশুকে এই চারটি বুনিয়াদী ধাপ ৬-৮ মাসেই শিখিয়ে দেওয়া সম্ভব। তারা কিছু কিছু ইতোমধ্যেই শিখেছে। তাই এদের কাকে কোন্ ধাপের কোন্ পাঠ থেকে শেখানো শুরু করতে হবে তা আগে দেখে নিতে হবে। এটা দেখে নেওয়ার জন্য একটা প্রগতি পত্রের নমুনাও দেওয়া আছে এখানে। কী কী শেখাতে হবে তার তালিকা ধরে ধাপে ধাপে এই বুনিয়াদী পাঠগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যত্ন নিয়ে শেখাতে হবে। এটাই হবে পরবর্তীকালে লেখাপড়ায় শিশুর অগ্রগতির বনিয়াদ।

কী কী শেখাতে হবে ৭–১৩ বছর

বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের পরিকল্পনায় প্রাথমিক স্তর বা ইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণি ( বয়েস ১০+ বছর) পর্যন্ত লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবা হলেও প্রাথমিকের পরেও অনেক শিশু চায় বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রেই উচ্চ-প্রাথমিকের পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে, বিশেষত অঙ্ক ও ইংরেজি শিখতে। এই কারণে ৭ থেকে ১৩ বছর (ইস্কুলের দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত অঙ্ক ও ইংরেজির পাঠ্যক্রম ও সেই অনুযায়ী পাঠগুলি তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেছে যেসব শিশুরা বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে বুনিয়াদী পাঠ থেকে শুরু করে লেখাপড়া শিখেছে তারা চতুর্থ শ্রেণি থেকে বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের বইয়ের পাঠগুলি নিজেরাই পড়ে বুঝে নিয়ে অনুশীলন করতে শিখে যায়। অঙ্ক ও ইংরেজির পাঠগুলো রাখা হয়েছে তিনটে করে খণ্ডে । প্রথম খণ্ডে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির (৭–৮ বছর) এবং দ্বিতীয় খণ্ডে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির (৯–১০ বছর) পাঠগুলো সম্পূর্ণ হলে তৃতীয় খণ্ডে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেখা যাবে। দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি শেখার এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, ও আলাদা একটি পুস্তিকায় ইংরেজি ব্যাকরণের বিষয়গুলি বাংলায় ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয়েছে। অঙ্কের তৃতীয় খণ্ডে ইস্কুলের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাটিগণিতের পাঠগুলো সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
প্রগতি পত্র — শিশু কোন ধাপে কতটা শিখেছে
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিক্ষণ পদ্ধতিতে ইস্কুলের মতো শিশুদের একযোগে একই পাঠ পড়ানো হয় না। প্রত্যেক শিশুকেই আলাদা করে দেখা হয়, কে কতটা কেমন শিখেছে ও সেই অনুযায়ী তাকে তার পাঠটি ধরে শেখানো হয়। এর জন্য পাঠের তালিকা ধরে যাচাই করে নিতে হয় কে কোন্ পাঠ কতটা শিখেছে বা শেখেনি, ও সেই অনুসারে তাকে তার প্রয়োজন মতো পাঠ থেকে শেখাতে হয়। এই প্রগতি যাচাই করার পদ্ধতি হিসাবে একটি প্রগতি পত্রের নমুনা দিদিমণিকে দিয়ে দেওয়া হয়।

শিশুদের উপস্থিতি পত্রের নমুনা

বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে শান্ত নিরিবিলি পঠনপাঠন চর্চায় অযথা বাইরের হস্তক্ষেপ ও রোজকার নজরদারি দিদিমণি ও শিশুদের চর্চার স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে। তাহলেও বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে লেখাপড়ার চর্চা নিয়মিত হচ্ছে কিনা, কোন শিশুরা নিয়মিত আসছে আর কারা আসছে না সে বিষয়ে দিদিমণিকে নজর দিতেই হয় এবং তাঁর দায়বদ্ধতা থাকে এই বিষয়ে উদ্যোক্তাকে নিয়মিত অবহিত করার। এই কারণে প্রতিদিন শিশুদের দৈনিক উপস্থিতির হিসেব রাখা প্রয়োজন। এই উপস্থিতি রাখার জন্য একটি উপস্থিতি পত্রের নমুনা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রতি মাসে শিশুদের দৈনিক উপস্থিতির হিসেব রাখা যাবে, ও উল্লেখ থাকবে শিশুর সংক্ষিপ্ত নাম, বয়েস, ও প্রাক্-প্রাথমিকের কোন্ ধাপে বা ইস্কুলে প্রাথমিকের কোন্ শ্রেণিতে পড়ছে। প্রতি মাসের উপস্থিতি পত্রগুলি দিদিমণি সংরক্ষিত রাখবেন ও সম্ভব হলে মাসের শেষে স্মার্ট ফোনে মাসের উপস্থিতি পত্রের ছবি তুলে উদ্যোক্তাকে পাঠাবেন।
শিশুদের প্রগতি পর্যবেক্ষণ কীভাবে
শিশুদের কার অগ্রগতি কেমন জানার জন্য ইস্কুলে পরীক্ষা নেওয়ার যে ব্যবস্থা প্রচলিত, তা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়, অন্তত প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত তো নয়ই। সব শিশু যে একই ভাবে শিখবে ও একই ভাবে তালে তালে তার শেখা এগোবে, এমনটা আদৌ হয়না। আজ যে এগিয়ে কাল সে হয়তো পিছিয়ে পড়ে, আর আজ যাকে মনে হয় কিছুই পারে না, কাল সে হয়তো সকলকে ছাপিয়ে যায়। তাই প্রতি বছর একযোগে সকলকে একই প্রশ্নমালা দিয়ে তাদের উত্তরের মূল্যায়ন করে বলে দেওয়া কে কতটা ভাল বা কে কতটা খারাপ একেবারেই অর্থহীন। পরীক্ষা নয়, কিন্তু শিশুরা ঠিক মতো শিখছে কিনা তার নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। শুধু সেটা দেখাই নয়, এই পর্যবেক্ষণের আরেকটা উদ্দেশ্য হল দিদিমণিদেরও দেখিয়ে দেওয়া, কেন কোন্ শিশু ঠিক শিখতে পারেনি, কোথায় ভূল হচ্ছে, ধাপে ধাপে কীভাবে শেখাতে হয়, কোথায় জোর দিতে হয়। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের পাঠ্য পুস্তিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশ দেওয়া থাকলেও তা দিদিমণিরা সর্বদা পড়ে বুঝে ঠিক ঠিক অনুসরণ করে উঠতে পারেন না। তাই দিদিমণিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়াও এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার আর একটি উদ্দেশ্য। ধাপে ধাপে এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার যে বিশেষ পদ্ধতি বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।

