Localisation

তথ্যে ভারাক্রান্ত মানুষ

একমাত্রিক মানুষ — আছি শুধু আছি

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করে, আর বাজারব্যবস্থা তাকে করে উন্মুক্ত — এমনটাই বলা হয়ে থাকে। বাজারের নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে পণ্য পছন্দের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার হিসাবে কথাটা হয়তো গ্রহণযোগ্য মনে হবে, যদিও বাস্তবটা তা নয়। বাজার কিন্তু যাবতীয় বৈচিত্র্যের বিরোধী—ভাষা বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি বৈচিত্র্য, খাদ্য বৈচিত্র্য, পোশাকআশাক বৈচিত্র্য, এক কথায় জীবনযাপনের বৈচিত্র্য তথা পছন্দ বৈচিত্র্যের বিরোধী। কারণ, তা না হলে কোনও পণ্যের বাজার বাড়বে কী করে।

একটু গভীরে গিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, বাজার ব্যবস্থায় আমরা সকলে পরাধীন হয়েছি আরেক ভাবে। মানবিক অস্তিত্ব হারিয়ে ক্রমাগত বন্দী হচ্ছি অর্থনৈতিক অস্তিত্বের প্রকোষ্ঠে — বাইরের জগতের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, আর পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়, পাল্টে নিতে হয় নিজেকে ক্রমাগত। এই স্রোত চলেছে অবিরাম। আর এরই স্রোতে উন্নতি কথাটাও অর্থহীন হয়ে পড়েছে। যার যত আর্থিক উন্নতি তাকে তার আর্থিক আয়কে নিশ্চিত করে রাখতে তত বেশি সময় দিতে হয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

এক অদ্ভুত প্যারাডক্সের সৃষ্টি হয়েছে জীবনযাপনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই। বহুকাল আগে বার্ট্রান্ড রাশেল এমনই এক প্যারাডক্সের উল্লেখ করেছিলেন মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে — যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, মানুষ অনেক কম সময়ে দূরে যেতে পারছে, আর তার ফলে মানুষ আরও বেশি সময় যাতায়াতেই ব্যয় করছে! এ কেমন উন্নতি?

দ্রুত পাল্টে চলা এই বাইরের জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্রমাগত চেষ্টার ফলে এক বড় সঙ্কট তৈরি হয়েছে আমাদের মনোজগতে। বাজারের পণ্যবস্তু ও পরিকাঠামো নির্মাণের বিস্ফোরণ ক্রমাগত আচ্ছন্ন করছে, ভারাক্রান্ত করছে আমাদের, বিশেষত শহরবাসী মানুষকে। চারপাশের বিস্ফোরিত জগত কেবলই আরও বেশি, আরও বেশি তথ্যময় হয়ে উঠছে সকলেরই কাছে।

যা আমি নই, যেখানে আমার প্রতিফলন নেই, যার সাথে আমার আত্মিক, চিরাচরিত, অতিপরিচিত বা সহজাত যোগাযোগ নেই, এমন সব কিছুই আমাদের চেতনায় এক একটি তথ্য হয়ে ঢোকে। বিস্ফোরিত পৃথিবীর বিস্ফোরিত তথ্যের আধিক্যে আমরা আজ দিশেহারা। দৈনন্দিন জীবনযাপনে সৃষ্টি হয়ে চলেছে অনিশ্চিত, অভূতপূর্ব সব সমস্যা, অদ্ভুত সম্পর্কের বোঝা, আর নানান মানসিক প্রতিক্রিয়া।

গত কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত তথ্যের বৃদ্ধি ঘটেই চলেছে। একে আজকাল তথ্য বিস্ফোরণ (information explosion) নাম দেওয়া হয়েছে। বিষয়টা নজরে এলেও মানুষের মন ও সমাজের ওপর এর কী প্রতিক্রিয়া সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। বিজ্ঞানীদের কিছু গবেষণা অবশ্য আছে, কিন্তু সে আমাদের কাছে বিশেষ পৌঁছয় না। তথ্যের আধিক্য (information overloading) মানুষ ও তার সমাজজীবনে এক বিশেষ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যাকে বোধহয় তথ্যদূষণ (ইন্‌ফরমেশন পলিউশন) বলা ভুল হবে না। তথ্যের বিকৃতি বা ভুল তথ্য নয়, সঠিক তথ্যেরই মাত্রাতিরিক্ত আধিক্যই হয়ে দাঁড়ায় এক দূষণ, যেমন সুমধুর সঙ্গীতও অতি জোরে হলে সৃষ্টি করে শব্দ দূষণ।

আমরা জানতাম, প্রত্যেক মানুষেরই উচিত যত বেশি সম্ভব জানা, খবরাখবর রাখা—যার ভাণ্ডারে যত বেশি জানা বা তথ্য সে তত বড় জ্ঞানী। কিন্তু আজকাল তথ্যদূষণের ফলে উল্টোটাই সত্যি হয়ে উঠছে। এক দিকে ঘটছে তথ্য বিস্ফোরণ, আর অন্য দিকে বাড়ছে এই তথ্য বিস্ফোরণকে মানুষের মগজে ঢোকাতে রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকা, ও সর্বোপরি তথ্যপ্রযুক্তির সর্বগ্রাসী উপস্থিতি ও প্রসার। একটু সচেতন না থাকলে হয়তো আজ যে যত বেশি জানবে, সে ততটাই মূর্খ হবে, এ সম্ভাবনা অলীক নয়।

তথ্যের বিস্ফোরণ

তথ্যের পরিমাণের একককে বলা হয় বিট (bit), আর তথ্যপ্রবাহের হারকে মাপা হয় বিট পার সেকেন্ড (bps) দিয়ে। অবশ্য এসব হিসাবে তথ্যের অর্থকে ধরা হয় না। একই তথ্যের অনেক অর্থ হতে পারে যা মাপা এখনও সম্ভব হয়নি, কারণ তথ্যের অর্থ নির্ভর করে তথ্য গ্রহণকারীর সিদ্ধান্ত, গ্রাহক ও প্রেরকের সম্পর্ক, এ সমস্ত কিছুর ওপর। তাই যে কোনও অবস্থা বা পরিবেশে যত রকম নির্দেশ (signal), বার্তা (message), বা বর্ণ (symbol) আছে, সেইগুলোকেই তথ্য বলা হয়।

তথ্য বহন করে এমন সমস্ত কিছুকেই মার্কার (marker) বলা হয়। সেই প্রাচীন কালের শিলালিপি থেকে বর্তমান কালের খবরের কাগজ, বইপত্র, শব্দ তরঙ্গ, আলোক তরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ, কম্পিউটারের ডিস্‌ক, মাইক্রওয়েভ, সবকিছুই তথ্য বহনকারী মার্কার। এমনকি, একজন মানুষের কাছে তার আশেপাশের পরিমণ্ডল, অন্যান্য মানুষজনের আচারব্যবহার, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা ইত্যাদি সবই মার্কার হিসাবে কাজ করে।

যোগাযোগের সময় এই মার্কার প্রবাহিত হয় প্রেরক থেকে গ্রাহকে ও সেই সাথে তথ্যের পরিবহন ঘটে। তথ্যের আধিক্যের সাথে সাথে তার স্রোত মানুষের মনে এসে আছড়ে পড়লে তবেই সৃষ্টি হতে পারে দূষণ। তাই তথ্যদূষণের দুটো দিক — এক দিকে তথ্য বিস্ফোরণ ও অন্য দিকে যোগাযোগ বিস্ফোরণ। এই দুটো বিস্ফোরণের বর্তমান চেহারা সম্বন্ধে অল্প কিছু আন্দাজ করা যেতে পারে।

শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাময়িক পত্রিকার সংখ্যা প্রতি কুড়ি বছরে দ্বিগুণ হয়েছে ১৮০০ সাল থেকে। ১৯৯০ দশকে এসে এই ধরনের সাময়িক পত্রিকার সংখ্যা পৃথিবীতে কমপক্ষে ৭৫ হাজার, যেখানে ছাপা হচ্ছে প্রায় ১২ লক্ষ গবেষণাপত্র। এছাড়া আছে বছরে প্রায় ৬০ হাজার বিজ্ঞান বিষয়ক বই আর এক লক্ষ গবেষণা সংক্রান্ত রিপোর্ট। বিজ্ঞান গবেষণার জগতেই তথ্যের এই বিস্ফোরণ।

আন্দাজ করাই যেতে পারে অন্যন্য সব ক্ষেত্রেই তথ্যের কী পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটছে। প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস ইত্যাদি নানা ধরনের খেলা ও প্রতিযোগিতা, অবিশ্রান্ত ধারায় সৃষ্টি হচ্ছে গান-বাজনার রেকর্ড, ক্যাসেট, আর সিনেমা, টিভি সিরিয়াল। এসবকে কেন্দ্র করে আছে নানা উৎসব, ঘটনা ও কেচ্ছাকাহিনীর সংবাদ। উৎপাদিত হচ্ছে নতুন ফর্মুলায় উন্নতমানের নতুন নতুন বস্তু, আর তার সংবাদ নিয়ে প্রচারিত হচ্ছে বিজ্ঞাপন। ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন গোত্রের বই আর পত্র-পত্রিকা। আর আছে রাজনৈতিক উত্থানপতন ও অস্থিরতার ঘটনাস্রোত। পাশাপাশি শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক উত্থানপতনের সংবাদেরও কোনও শেষ নেই।

রোজকার জীবনযাপনেও তথ্যের আধিক্য। নতুন নতুন গৃহস্থালির যন্ত্র ব্যবহার ক্রমাগত অবশ্যপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। জানতে হচ্ছে এদের ব্যবহার ও মেরামতির তথ্যগুলো। আছে বীমা সংক্রান্ত নিয়মাবলী, আয়কর দেওয়ার নিয়মাবলী, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, এমনকি বড় শহরের রাস্তায় হাঁটাচলার নিয়মাবলী— কখন রাস্তা পার হতে হয়, কোন রাস্তা কখন কোনমুখি, কোন বাস কোথায় যায়, কোন ট্রেন কখন আসে, কোথায় দাঁড়ায় — এসব না জানলে কপালে থাকে অশেষ দুর্ভোগ।

জানতে হয় বাজার দর, কোথায় কী পাওয়া যায়, কী হলে কী করতে হয়—থানা, পুলিশ, হাসপাতাল, মর্গ। জানতে হয় নিজের কর্মসংক্রান্ত তথ্য ছাড়াও কর্মক্ষেত্রের হাওয়া বদলের খবরাখবর। এরপর আছে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের খোঁজখবর। সামাজিক মেলামেশাও এনে দিচ্ছে তথ্যের স্রোত। মানুষের ভিড়ও বয়ে আনে তথ্য। যে কোনও বড় শহরের রাস্তায় হাঁটলেই মিনিট দশেকের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষের সামনে পড়তে হয়।

তথ্য বিস্ফোরণের পাশাপাশি চলেছে যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্ফোরণ। পরিবহন, ডাক ও তার (টেলিগ্রাফ) ব্যবস্থার প্রসারের পর গত দুই দশকে এসেছে ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন টেকনোলজির যুগ। আজ ইন্টারনেটের ফলে সারা পৃথিবী যেমন মানুষের দোরগোড়ায়, তেমনি মানুষও উন্মুক্ত হয়েছে বহির্জগতে। দৈনন্দিন জীবনে ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে ঘটছে অতিবিস্তৃতি । কিছুকাল আগেও মানুষ একটা সীমিত ও নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যেই ঘোরাফেরা করত, কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছিই ছিল তার অবস্থান। এখন দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এসে মিলছে একই কর্মক্ষেত্রে, বহন করে আনছে বিভিন্ন তথ্য। সামাজিক মেলামেশারও কোনও স্থানীয় গ্রন্থি নেই। সেও বয়ে আনছে আরও তথ্য।

নিখোঁজ মন

তথ্যের আধিক্য মানুষের মনে সৃষ্টি করতে পারে নানান প্রতিক্রিয়া। আর্থার সি ক্লার্ক (Arthur C. Clarke) তাঁর ‘প্রোফাইলস অভ দ্য ফিউচার’ (Profiles of the Future) বইটিতে মন্তব্য করেছিলেন, মানুষের energy বা mass–য়ের অভাব ঘটবে না, কিন্তু মানুষ খুব সহজেই বুদ্ধিহীন হয়ে যেতে পারে। নানান গবেষণা থেকে আজকাল জানা যায় যে অতিরিক্ত তথ্যের স্রোতে মানুষ বুদ্ধিহীনের মতো আচরণ করতে পারে।

মানুষের মস্তিষ্কে তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা নির্দিষ্ট। একটা সীমা পর্যন্ত তথ্য গ্রহণ মানুষকে বুঝতে সাহায্যই করে। কিন্তু এরপরেও দ্রুত বেগে তথ্য এসে পড়তে থাকলে মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত হয়। সৃষ্টি হতে থাকে প্রথমে বিভ্রান্তি, দিশেহারা অবস্থা ও পরিশেষে আসে অবসাদ, অনীহা ও বিকর্ষণ। সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় যান্ত্রিক আচরণের ঝোঁক।

আমরা সকলেই নানা ভাবে চেষ্টা করি তথ্য-আধিক্যের চাপ সামলাতে। এই চেষ্টার রকমগুলো হল — কিছু তথ্য ভুলে যাওয়া (omission), কিছু তথ্য সম্বন্ধে ভুল করা (error), বাছাই করে কিছু তথ্য গ্রহণ করা (filtering), তথ্যকে গোল গোল অস্পষ্ট করে রাখা (abstracting), কিছু তথ্যের ভার অন্যের ওপর ন্যস্ত করা (multiple channel), কিছু তথ্যকে গ্রহণই না করা (escape), অনেক তথ্যকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে অতিসরলীকৃত একটি সহজ তথ্য হিসাবে দেখা (oversimplification বা chunking), কিছু তথ্য জেনেও সে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া (queing)।

তথ্যের চাপ না নিতে এসব করতেই হয়। কেউ কেউ queing–য়ের সাহায্য নিয়ে সর্বদাই পাথর হয়ে বসে থাকেন—এঁরা অনেক কিছু জেনেও কোনও কিছুই করতে চান না সহজে, সব কিছুই ফেলে রাখতে চান হচ্ছে হবে করে। কেউ আবার filtering–য়ের পথে সরাসরি নিজের ব্যাপার নয় এমন কোনও বিষয়েই মাথা ঘামাতে চান না।

ব্যবহার দেখা যায় multiple channel–য়েরও। নিজের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাধারণ তথ্য ও চিন্তাভাবনার ভার দেওয়া থাকে চিকিৎসকের ওপর, আয়করের হিসেব থাকে ট্যাক্স-কনসালটেন্টের কাছে, বাড়িঘর সাজানো কী নিজেকে সাজানো তার ভাবনাও অন্যের ওপর দেওয়া যায়, কর্মব্যস্তদের নিজস্ব সেক্রেটারি তো থাকেই আর আমরাও চেষ্টা করি ছোটখাট কাজের দায়িত্ব নিজের লোকের কাছে চালান করে দিতে। Chunking থেকে প্রবণতা হয় কোনও বিষয়েরই গভীরে না গিয়ে কোনও একটা ছাঁচে ফেলে চটপট একটা মোদ্দা কথা বুঝে ফেলা। ফলে বহু বিষয়েই ওপর ওপর জানা ও মন্তব্য করে কাজ সারা যায়।

তথ্যের আধিক্য সামলাবার এত সব চেষ্টার পরেও কিন্তু সৃষ্টি হয় অবসাদ, বিভ্রান্তি, বিরক্তি, আর দিশেহারা অবস্থা। এর দেখা মেলে সর্বদাই। আলাপ-আলোচনায় দেখা যায় বহু তথ্যের শুধুই প্রদান, আদান নয় — সকলেই শুধু বলেন, শোনেন না কেউই। জগতের খবরাখবর থেকে টের পাই অনেক কিছু ঘটছে; কিন্তু ঠিক কী যে ঘটছে তা আর বোঝা হয় না। কাগজপত্রের পাহাড় জমে ওঠে, বহু পত্রপত্রিকা না পড়েই ফেলে দিতে হয় বাজে কাগজের ঝুড়িতে।

গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার বা বক্তৃতা সভায় দেখা যায় সামনের সারির স্বনামধন্য কেউ কেউ ঘুমিয়েই পড়েছেন। এসবই মূলত শহরবাসীর জীবনযাপনের ছবি। ছিন্নমূল, গ্রন্থিহীন তথ্যের আধিক্যে গাছের ভিড়ে জঙ্গল হারায়। অনেক তথ্য জানার পরেও জানা হয় না ঠিক কী জানলাম, কেন এত তথ্য জানছি। সামগ্রিক অর্থহীনতা আর বিভ্রান্তির কুয়াশায় অবসন্ন আর সদাবিরক্ত মানুষ বেছে নেয় ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ জীবনের যান্ত্রিক আচরণ — যন্ত্রের মতো বেচেবর্তে থাকার রুটিন।

প্রাথমিক অবস্থায় মানুষের মনে তথ্যদূষণের প্রভাব সাময়িক। তথ্যের আধিক্য দূর হলে প্রতিক্রিয়াগুলোও দূর হয়ে যায়। তাই কিছুদিনের জন্য হলেও প্রকৃতির বুকে কোথাও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ পেলে মানুষ নিজেকে ফিরে পায়, স্থিতধী হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবত তথ্যদূষণের ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে হয়তো মানসিক গঠনটাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যাকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।

এ কথা ঠিক যে মানুষের মস্তিষ্কের অনেকটা অংশই অব্যবহৃত থাকে, যাকে বলা হয় latent possibility of human brain। কিন্তু মস্তিষ্কের এই ঘুমন্ত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করার উপায় জানা যায়নি। অনেকেই ভাবতে পারেন যে তথ্য আধিক্যের চাপে মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে একে ধারণ করতে। মূলত কল্পবিজ্ঞানের এই ভাবনার কোনও ভিত্তি নেই, আর সে সম্ভাবনা থাকলেও তার সুফল পেতে আমাদের কয়েক প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে।

আপাতত বিভিন্ন গবেষণা থেকে যানা যাচ্ছে, অতি দ্রুত হারে তথ্যের আধিক্যের ফলে বর্তমান প্রজন্মের মানুষেরা বুদ্ধিহীন হয়ে পড়তে পারে, তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এর ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে আসতে পারে সিজোফ্রেনিয়া। এঁরা একদিকে তথ্য filtering করতে অক্ষম হয়ে পড়েন, দরকারি তথ্য বাছাই করতে না পেরে যাবতীয় তথ্যের বোঝা নিয়ে দিশেহারা হতে থাকেন, তাই অন্য দিকে বাড়তে থাকে escape করার প্রবণতা — মানুষের সংস্পর্শও পরিত্যাজ্য মনে হতে থাকে।

হারাতে বসেছে তত্ত্ব

আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে যুক্তি-বুদ্ধির সাহায্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার প্রয়োগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথার্থ অগ্রগতির ক্ষেত্রে। মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারে সঞ্চিত তথ্য ও তার বৃদ্ধির হার দেখে সেই ১৯২১ সালেই চিন্তিত হয়েছিলেন এইচ জি ওয়েলস ( H. G. Wells)। দার্শনিক অর্তেগা ওয়াই গ্যাসে (Ortega y Gasset) বইয়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি দেখে ১৯৩৬ সালে বলেছিলেন, মানুষের প্রয়োজন বইকে শাসনে বাঁধা (man must tame the book)। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) ১৯১৩ সালেই অনুভব করেছিলেন, এক বই থেকে আর-এক বই উৎপন্ন হয়ে পুঁথি আর কথার অরণ্য মানুষের চারিদিকে নিবিড় হয়ে উঠছে।

সম্ভবত অ্যারিস্টটলের পরে আর কোনও মানুষের পক্ষেই তার হাতের কাছের সমস্ত নথিভুক্ত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। ১৯৬০-য়ের দশকেও হয়তো কোনও নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব ছিল অন্তত তাঁর নিজের বিষয়টির গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো পড়ে ফেলা। আজ আর কোনও বিষয়েরই অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশেও এই কাজ সম্ভব নয়। ফলে দেখা যাচ্ছে নতুন গবেষণাগুলো অনেক সময়েই পুরনো গবেষণার পুনরাবৃত্তি — যা জানা হয়ে গেছে তাকেই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো।

অনেক গবেষণা হচ্ছে, বই লেখা হচ্ছে মানেই যে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে, তা বোধহয় বলা যায় না। উল্টে, সোজা একটি বিষয়কেই নানা ভাবে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে দেখার ফলে জ্ঞানের স্বাভাবিক অগ্রগতি রুদ্ধ হচ্ছে বিপথে ঘুরে। সৃষ্টি হয়েছে আরেক সমস্যা — সহজ অথচ গুরুত্বপূর্ণ কোনও গবেষণা হারিয়ে যাচ্ছে এই বাঁকাচোরা গবেষণার ভিড়ে।

তথ্যদূষণই সৃষ্টি করে আরও নতুন নতুন তথ্য, আরও তথ্যদূষণ। তথ্যের আধিক্যে যাবতীয় তথ্যকে বিচার করা সম্ভব না হলে প্রবণতা হয় অল্প কিছু তথ্যের ওপর নির্ভর করে বক্তব্য, অর্থাৎ নতুন তথ্য নির্মাণ করার। সমগ্র সম্বন্ধে ধারণা করা না গেলে সমগ্রের অংশগুলোই খালি নজরে আসে। এই আংশিক তথ্যগুলোকেই ভেঙেচুরে নানা ভাবে সাজিয়ে তৈরি হয় আরেক ভাবে দেখার তথ্য। ক্রমান্বয়ে এই অংশগুলো সম্বন্ধেও ঘটে তথ্যের আধিক্য, তারাও ভাঙতে থাকে আরও ক্ষুদ্র অংশে। এই ভাবে তথ্যবিস্ফোরণ পায় তার নিজস্ব গতি — তথ্যরা ক্রমাগত ভাঙতে থাকে, সৃষ্টি হয় আরও তথ্য; তারাও আবার ভাঙতে থাকে।

তথ্য মানেই যে জ্ঞান নয়, এই সাধারণ কথাটা আমরা ভুলতে বসেছি তথ্যের ভারে। জ্ঞানের অগ্রগতির বিষয়টা শুধুমাত্র তথ্য পাওয়া নয়, তথ্যকে বোঝার সঠিক তত্ত্ব পাওয়া। তত্ত্ববিহীন তথ্যের অর্থ থাকে না। জ্ঞানের অগ্রগতি শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে হয় না, চাই সামগ্রিক তত্ত্বের কাঠামো। এ না হলে তথ্যরা সব বিচ্ছিন্ন থেকে যায়, অনেক তথ্য জেনেও কিছুই বোঝা হয় না। অথচ, আজ তথ্যবিস্ফোরণের ফলে মানুষ হারাতে বসেছে তার তত্ত্ব।

তথ্যদূষণের ফলে দুটো বিশেষ প্রবণতা — অতিসরলীকরণ বা যে করে হোক সব সমস্যার কোনও চটজলদি সহজ সমাধান খুঁজে নেওয়া, এবং নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে কিছুই জানতে না চাওয়া — সৃষ্টি করেছে আরও সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা আজ বিশেষ বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সহজাত প্রক্রিয়াটাও ব্যাহত। মানুষের জ্ঞান অর্জনের একটা প্রধান অস্ত্র হল তার আন্দাজ করার শক্তি (intuition), যার থেকে তৈরি হয় এক অব্যক্ত জ্ঞান (tacit knowledge)।

মানুষ এতকাল আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েই এগিয়েছে — নতুন তথ্য জোগাড় করেছে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে আন্দাজকে বিচার করেছে, প্রয়োজন মতো নতুন আন্দাজ তৈরি করেছে ও নতুন তথ্যের সন্ধান করে আবার এগিয়েছে। এই ভাবেই জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষ তার জানার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে, মানুষ অগ্রসর হয়েছে। নিউটন সাহেবের মাথায় আপেল পড়াতে মাধ্যাকর্ষণ নিয়মের প্রমাণ হয়নি; নিউটন সাহেবের মাথায় শুধু একটা আন্দাজ তৈরি হয়েছিল।

মানুষের সহজাত যুক্তি-বুদ্ধি ও আন্দাজ করার এই প্রক্রিয়াটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তথ্যদূষণে। অতিরিক্ত তথ্যসমৃদ্ধ ব্যক্তি তার অজান্তেই আন্দাজ করার শক্তি হারায়, আন্দাজ করাকে নিন্দনীয় মনে করতে থাকে, আসে যান্ত্রিক যুক্তির ব্যবহার। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন লক্ষণীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে — ‘অন্ধ জনে দেহ আলো’ আর ‘মৃত জনে দেহ প্রাণ’ আজ যেন প্রায় সম্ভব হয়ে উঠেছে। কিন্তু খুবই ছোট্ট সাধারণ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিভ্রাট বোধহয় বেড়েই চলেছে। কারণ চিকিৎসকের জ্ঞানের অভাব নয়, যান্ত্রিক যুক্তির ব্যবহার।

আগেকার দিনে চিকিৎসক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে, তার অসুস্থতার বিবরণ শুনে কিছু আন্দাজ (clinical impression) খাড়া করতেন। এর পিছনে কাজ করত তাঁর অব্যক্ত জ্ঞান। এই আন্দাজ সম্বন্ধে স্থির নিশ্চিত হতে না পারলে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে যাচাই করতেন আরও তথ্যপ্রমাণ। আজকাল পদ্ধতিটাই গেছে প্রায় উল্টে। আগেই বহু পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে রোগীর স্বাস্থ্য বিষয়ে বহু তথ্যের সমাবেশ করে সেগুলির সর্বপ্রকার সমন্বয়ে কোনও একটি আসল রোগ নির্ণয় করা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অধিকাংশ সময়।

মানুষের সহজাত যুক্তি-বুদ্ধি, যা খানিকটা আন্দাজকে আশ্রয় করে চলে, আর যান্ত্রিক যুক্তির (Artificial Intelligence) তফাতটা দেখা যেতে পারে। মানুষ-চিকিৎসকের পক্ষে অসুস্থতার পাঁচটা সামগ্রিক বা মূল তথ্য বিচার করে রোগটা কী সে সম্বন্ধে আন্দাজ করা সম্ভব, কিন্তু এমন পঞ্চাশটা তথ্যকে একযোগে বিচার করে সিদ্ধান্তে আসা প্রায় অসম্ভব। যান্ত্রিক চিকিৎসক বা কম্পিউটারের ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। সে পঞ্চাশটা তথ্যকে পূর্ব-নির্ধারিত যুক্তি অনুসারে একযোগে বিচার করে গোটাকয়েক সম্ভাব্য রোগের নাম করে দিতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র পাঁচটি তথ্য দিলে সে হয়ত পঞ্চাশটা রোগের নাম বলবে, কোনও আন্দাজই করতে পারবে না।

যান্ত্রিক যুক্তি দিয়ে একযোগে বহু তথ্য বিশ্লেষণ করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, এটা কেবল পূর্ব-নির্ধারিত যুক্তি অনুসারেই চলে। কোনও নতুন তথ্য, যা এতকাল অজানা ছিল, তাকে যান্ত্রিক যুক্তি গ্রহণ করতে পারে না; গ্রহণ করলেও তাকে নিজস্ব যুক্তির ছাঁচে গড়ে নেয়। একদিকে তৈরি হয় নতুন তথ্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা, আর অন্যদিকে থাকে অতিসরলীকরণের চেষ্টা।

তথ্যময় একাকী মানুষ

তথ্যদূষণের ফলে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে এসেছে অনিশ্চিত, অভূতপূর্ব সব সমস্যা, অদ্ভুত সম্পর্কের বোঝা আর আর ফলে নানান মানসিক প্রতিক্রিয়া। এক জীবনেই এত সব অভিজ্ঞতা আগে ভাবাই যেত না। তথ্যের আধিক্যে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আসে বিভ্রান্তি, বিকৃত ধারণা, দিশেহারা অবস্থা ও শেষমেশ অবসাদ আর অনীহা। আলভিন টফলার (Alvin Tofler) ১৯৭০ সালে ‘ফিউচার শক’ (Future Shock) নামে বইটিতে আধুনিক সমাজজীবনে এর কারণ হিসাবে তথ্যের আধিক্যকে চিহ্নিত করেছিলেন।

আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার পরিকাঠামোয় গড়ে ওঠা বর্তমান তথ্যসভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য আকর্ষণীয় তথ্যের বাহুল্য। নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে এক পা ফেললেই এসে পড়ে হাজারে হাজারে নতুন তথ্য। এইসব তথ্য সৃষ্টি করে জীবনযাপনের ঢঙ ও সামাজিক আচরণ নিয়ে উৎকণ্ঠা, আসে সিদ্ধান্ত সঙ্কট — ঠিক কী ধরনের যাপন ও আচরণ অনুকরণ করা উচিত। অথচ তথ্যরা ক্রমাগত নির্দেশ করতে থাকে এবার থেকে কীভাবে চলতে হবে। এই উৎকণ্ঠা আনে অস্থিরতা যা শেষমেশ পর্যবসিত হয় অনাবশ্যক আক্রমণাত্মক আচরণে অথবা একেবারেই হাল ছেড়ে দেওয়া আত্মসমর্পণে।

বড় শহরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়েও একজন মানুষ নিঃসঙ্গ, একাকী। আশেপাশের মানুষেরা অজানা, অচেনা ও বস্তুত এক একটি তথ্যের ভাণ্ডার, যা এড়িয়ে চলতে হয়, নয়ত একগাদা তথ্য এসে পড়ে। এই ভয়েই হয়তো, রবীন্দ্রনাথের কথায়, শহরে আছে এক জনময় নির্জনতা, যেখানে প্রত্যেকেই রবিনসন ক্রশোর মতো আপন আপন ফ্রাইডেটিকে নিয়ে দিন কাটান। আমাদের সব সম্পর্কই তাই কেমন ছাড়া ছাড়া, দূরত্ব বজায় রেখে চলা; কেউই কোনও বিষয়ে বেশি জড়াতে চাই না।

তথ্যে বিস্ফোরিত পৃথিবীর মানুষের মানবিক সম্পর্কের জগতটা যায় ভেঙে। নিজের বিষয়গুলোর জন্য সময় ও শক্তি বাঁচাতে অন্যের ব্যাপারে কেউই জড়াতে চাই না। ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নিয়মিত যাতায়াতের সূত্রে আবার গাদাখানেক তথ্য এসে না পড়ে, এই ভয়ে উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের বদলে শুষ্ক, বিরাগের আচরণ করি। যে সম্পর্কগুলো একান্তই থেকে যায়, রাখতেই হয়, তাকে যথাসম্ভব ব্যবহারিক ও নৈর্ব্যক্তিক করে রাখতে চাই, কারণ এতে তথ্যময় সম্পর্কের — একে অপরকে জানা-বোঝার— ঝামেলাটা কমে।

সামাজিক আচরণের এই পরিবর্তন আমাদের রক্ষা করে তথ্যের আধিক্য থেকে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন করে চারপাশের জীবনস্রোত থেকে। কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কও হয়ে পড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের মতো নৈর্ব্যক্তিক। জীবানন্দের ভাষায়, সকলের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি হতেছি আলাদা। এই বিচ্ছিন্ন মানুষের কাছে তার নিকটতম জগতটাও হয়ে উঠতে থাকে অজানা, অচেনা, আর সেই কারণেই আরও তথ্যময়। সে তাই খোঁজে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ।

আমাদের সকলের আচরণ যে একই ভাবে পালটায় তা নয়। প্রত্যেকেই তার অবস্থান ও তথ্যভার অনুযায়ী তার মতো করে আচরণ পরিবর্তন করে। ফলে তৈরি হতে থাকে তথ্যে ভারাক্রান্ত অসংখ্য ধরনের মানুষ, যাদের গুণগত অমিল বেড়েই চলে, আর একে অপরের কাছে হয়ে উঠতে থাকে আরও তথ্যময়। এই পাঁচমেশালি মানুষে সমাজের কোনও চরিত্র থাকে না; সমাজ হয়ে ওঠে আসলে এক তালগোল পাকানো মেলামেশার ক্ষেত্র ও নেহাতই সময় কাটানোর ঘটনা মাত্র। সমস্যা আসে কথা বলার ক্ষেত্রে। দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসিকতার দুস্তর ফারাকে ভাষা দিয়ে ভাববিনিময় হয় ওঠে দুরূহ। ভাব-বিনিময়ের অক্ষমতায় কথাবার্তায় প্রাধান্য পেতে থাকে শুধুই তথ্যপ্রলাপের আদানপ্রদান। সকলেই শুধু বলি, শুনি না কেউই; শুনলেও বুঝি না তার মানে। ভাবের অভাবে শুধু তথ্যই চলে বেড়ে।

মানুষের তিনটে মাত্রা থাকে — অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু তথ্যে বিস্ফোরিত পৃথিবীতে মানুষের বর্তমানের আয়তন কেবলই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে — হারিয়ে গেছে অতীতের স্মৃতি, নেই কোনও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। মানুষ আজ একমাত্রিক (one dimensional man) —যার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই, আছে শুধু বর্তমান। রোজকার জীবনে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত একমাত্রিক মানুষ তার জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যোগসূত্র হারিয়ে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের অস্তিত্বকে নিয়েই বাঁচে। তার বছর ভেঙে যায় মাসে, মাস ভেঙে যায় দিনে, দিন ভাঙে ঘন্টায়, মিনিটে। তার সমগ্র জীবন ও মানবিক সম্পর্কেরা পড়ে থাকে শত শত মুহূর্তের বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র হয়ে।

Reprinted: Ekk Matra, November 2000

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© Sutanu Bhattacharya