সার্ধশতবর্ষের বিস্মৃত অতীত— বাংলার শিক্ষা

অধম একে গরিব ব্রাহ্মণ, তায় পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি। বিপদে পড়লে গুরুর নাম ছাড়া পাথেয় কিছু নেই। বিপদের কারণ শিক্ষা। জীবিকানির্বাহ হয় শিক্ষকতা করে। প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে এসে অন্য কিছু করার ক্ষমতাও আর অবশিষ্ট নেই। এদিকে শিক্ষা নিয়ে সরকার বাহাদুরের ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ফতোয়ার স্রোত অব্যাহত শুধু নয়, সম্প্রতি তীব্রতর হয়েছে। তাই আজকাল ঘুমের ঘোরেও আঁতকে উঠি—শেষমেশ মানে মানে পার করে সরে পড়তে পারব তো?
কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকার নিয়োজিত একের পর এক শিক্ষা কমিশন ও তাদের মোটা মোটা রিপোর্ট তো আছেই। তাছাড়া আছে নানান প্রতিষ্ঠিত কমিশন ও কাউন্সিল গোছের সংস্থা, যারা প্রতিনিয়ত নিয়মাবলী তৈরি করে জানান দেয়, অতঃ কিম্, এবার থেকে কী কী করতে হবে। কত কী তো হল — ইন্টারমিডিয়েট, প্রি-ইউনিভার্সিটি থেকে ১১ ক্লাসের উচ্চ-মাধ্যমিক, সেখান থেকে মাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিকের ১০+২ প্রথা, দু-বছরের পাশ কোর্সকে বাতিল করে ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স, ডিসট্যান্স মোড, শিক্ষকের ন্যুনতম যোগ্যতার মাপকাঠিতে স্নাতকোত্তরে ৫৫ শতাংশ নম্বর, নেট-স্লেট, পিএইচডি, বছরে ১৮০ দিন, সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা, পাঁচ দিন পাঁচ ঘন্টা করে হাজিরা, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় গ্রেডেশন, চয়েস বেসড ক্রেডিট সিসটেম, কাফেটেরিয়া অ্যাপ্রোচ, মডিউলার ইউনিটাইজড কোর্স, স্টুডেন্টস ফীড ব্যাক, ছাত্র দ্বারা শিক্ষকের মূল্যায়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন — এই তালিকা অন্তহীন। যত দিন যাবে, এ বাড়বে বৈ কমবে না।
সম্প্রতি এসেছে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেশে আনার ভাবনা (ফরেন ইউনিভার্সিটি বিল) (Foreign University Bill), ও স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি, সবই প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থাকে অনুমতি দেওয়ার কথা। এই উত্তাল তরঙ্গে বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় আছেন সরকার স্বীকৃত অথবা মিডিয়া ভূষিত অথবা স্বঘোষিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাকর্মীরা যাঁরা স্থান পান বিভিন্ন এক্সপার্ট কমিটি (আজকাল নাম বদলে পিয়র টীম) বা উপদেষ্টা কমিটিতে (এরও আজকাল নাম বদলে হয়েছে মেন্টর গ্রুপ)। স্বভাবতই এঁরা যথাবিহিত কর্তব্য হিসাবে যোগ্যস্থানে বক্তব্য রেখে, কাগজে-কলমে লেখালিখি করে জানান দেন, এবার কী করণীয় বা হোয়াট ইজ টু বি ডান্। তবু বিতর্কের তো শেষ হয় না। প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি না মাতৃভাষা সে বিতর্ক তো ছিল এবং আছেই। এর পাশে এসেছে কম্পিউটার শিক্ষা, যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। প্রাইমারি স্কুলে ড্রপ-আউট বা স্কুলছুটদের সংখ্যা কমাতে এসেছে মিড-ডে মিল, প্রাইমারি স্কুল-শিক্ষকদের ন্যুনতম যোগ্যতায় বাধ্যতামূলক টিচার্স ট্রেনিং ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষা নেওয়া তো আগেই উঠে গেছে। সে যাই হোক, পরীক্ষায় পাশ-ফেল ব্যবস্থা রাখা হলেও স্কুল কলেজে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা কমই রাখতে হবে, নইলে তার জবাবদিহি করতে হবে যে। আর কিছু না পারি, পরিসংখ্যানে অন্তত শিক্ষাবিস্তারের প্রমাণ রাখার এমন উপায় আর কি হয়? শিক্ষাবাজারে ক্রেতার সংখ্যাবৃদ্ধিও তো চাই।
প্রশ্ন জাগে নিজেরই কাছে। গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নাকি সবকিছু চলে সর্বোত্তম পথে, বিতর্কই সেখানে স্বাস্থ্যের লক্ষণ। এমনটাই তো মনে হয় অমর্ত্য সেন মহাশয়ের ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ (The Argumentative Indian) বইটি থেকে। সুতরাং, যা হচ্ছে হোক না, ঠিকই নিশ্চয় হচ্ছে। আমি কেন এমন হতভাগ্য যে ও নিয়ে মাথা ঘামাই? সমস্যাটা হয়তো আমার নিজেরই। তিন দশকের বেশি হল শিক্ষকতা করি। শুনেছি কত শত কাক মরলে নাকি একটা শিক্ষক হয়। তার ওপর বংশগত ভাবে তিন প্রজন্মের শিক্ষক। শুনেছি এই তৃতীয় প্রজন্মে নাকি যাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানানো যায় না, তাই হয়।
আরেক বিপদ ঘটিয়েছে কর্মসূত্রে এক দিকে মেঠো আর অন্য দিকে সুরম্য অভিজ্ঞতা। মেঠো অভিজ্ঞতায় সুযোগ ঘটেছে বিহার, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের নিদেনপক্ষে শ’চারেক ও অন্যান্য রাজ্যের আরও কিছু প্রত্যন্ত গ্রামীণ কলেজ ও তার আশেপাশের ইস্কুলের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কিছু মেলামেশার, যা ওদের সাথে দু-তিন রাত্রিবাসেও গড়িয়েছে। দেখেছি, ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ শিক্ষাপ্রদীপের নিচে কত অন্ধকার, তারই আলোকে। অন্য দিকে জাতীয় স্তরে উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক বা আলাপ-আলোচনাতে কখনো স্থান পেয়েছি; উপলব্ধি হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ শিক্ষার প্রদীপ শিখা প্রজ্বলিত রাখতে সুরম্য বনবিতানে কর্তাব্যক্তিদের নৈশাহার-আলাপে মিলিত হওয়ার গুরুত্ব। এই দুই প্রান্তের অভিজ্ঞতা বোধহয় গুরুপাকই হয়েছে। তার ফলে কেবলই ভাবছি শিক্ষা নিয়ে এটা কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কেন এমনটা ঘটল। উত্তর মিলছে না, তাই গুরুর শরণাপন্ন হয়েছি এই বিপদে।
হাতের কাছেই ছিল বঙ্কিম (Bankim Chandra Chattopadhyay) আর রবীন্দ্র (Rabindranath Tagore) রচনাবলী। নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হল, আজ ইন্টারনেট আর মিডিয়ার দাপটে বইপড়া তো প্রায় উঠতে বসেছে, আর কারই-বা ধৈর্য থাকলেও সময় আছে এত মোটা মোটা বই পড়ার, পড়ে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার। আজকাল বিদ্যুতগতিতে কাজ হয়, কাজ করতে হয়। দেশের শিক্ষার উচ্চতম নীতিনির্ধারক মাননীয় কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, যার ভাবনা ধাবিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটি’ (world class university) ও তার প্রয়োজনে ‘একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ’-য়ের প্রতি, অথবা রাজ্যের ‘শিক্ষায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ (public private partnership in school education) ভাবনার প্রবক্তাদের সময় কোথায় যে বসে বসে এত বই পড়বেন। ওঁদের কাজ করে দেখাতে হয় পাবলিককে, সেও বিদ্যুতগতিতে। আমার মতো অকর্মণ্য তো নয়। সাধারণেরও সমস্যা — মনে প্রশ্ন জাগে, কিন্তু সে নিয়ে ভাবার সময় নেই, কারণ কাজ করে খেতে হয়। কবি গুরুর সার্ধশতবর্ষে মনে হয় বইপত্র লেখাপড়ার জগতে যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার এতই উন্নতি হয়েছে যে কবিগুরুও হয়তো এত হাজার হাজার পাতা লেখার নিরবচ্ছিন্ন অবসরই পেতেন না, যদি আজকালকার মতো করে খেতে হতো।
বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনায় যে কথাগুলো পেলাম, মনে হল অতি দীর্ঘ উদ্ধৃতি হলেও সেগুলোকে এক জায়গায় ধরে রাখি। আমার তো নতুন কিছু বলার নেই। শিক্ষা নিয়ে আজকাল যা সব ঘটছে, যেসব কথা শোনা যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারির মেলবন্ধনে, সে সম্বন্ধে তাঁদের বক্তব্যই যথেষ্ট। তাই আমার মতো হতভাগারা, যারা এইসব আজেবাজে প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামায়, তাদের উদ্দেশ্যেই এই উদ্ধৃতি। কর্তাব্যক্তিরা যে কর্ণপাত করবেন না সে তো জানাই আছে।
অতীতের ভাবনা আজ ভাবনার অতীত
বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭৮ সালে (বঙ্গাব্দ ১২৮৫) ‘লোকশিক্ষা’ প্রসঙ্গে লিখেছেন— “. . . বাঙ্গালার ছয় কোটি ষাটি লক্ষ লোকের দ্বারা যে কোন কার্য্য হয় না, তাহার কারণ এই যে, বাঙ্গালার লোকশিক্ষা নাই। যাঁহারা বাঙ্গালার নানাবিধ উন্নতি সাধনে প্রবৃত্ত, তাঁহারা লোকশিক্ষার কথা মনে করেন না। আপন আপন বিদ্যাবুদ্ধি প্রকাশেই প্রমত্ত। ব্যাপার বড় অল্প আশ্চর্য্য নহে।
“ইহা কখনো সম্ভব নহে যে, বিদ্যালয়ে পুস্তক পড়াইয়া, ব্যাকরণ, জ্যামিতি শিখাইয়া সপ্তকোটি লোকের শিক্ষা বিধান করা যাইতে পারে। সে শিক্ষা শিক্ষাই নহে, এবং সে উপায়ে এ শিক্ষা সম্ভবও নহে। . . . আমাদের একটুকু বিশ্বাস আছে যে, ব্যাকরণ জ্যামিতিতে সে শিক্ষা হয় না এবং রামমোহন রায় হইতে ফটিকচাঁদ স্কোয়ার পর্য্যন্ত দেখিলাম না যে, ইংরেজী-নবীশ সে বিষয়ে কোনো কথা কহিয়াছেন।
“এখনকার অবস্থা এইরূপ হইয়াছে বটে, কিন্তু চিরকাল যে এদেশে লোকশিক্ষার উপায়ের অভাব ছিল, এমত নহে। লোকশিক্ষার উপায় না থাকিলে শাক্যসিংহ কি প্রকারে সমগ্র ভারতবর্ষকে বৌদ্ধধর্ম্ম শিখাইলেন? মনে করিয়া দেখ, বৌদ্ধধর্ম্মের কূট তর্কসকল বুঝিতে আমাদের আধুনিক দার্শনিকদিগের মস্তকের ঘর্ম চরণকে আর্দ্র করে; মক্ষমূলার যে তাহা বুঝিতে পারেন নাই, কলিকাতা রিবিউতে তাহার প্রমাণ আছে। সেই কূটতত্ত্বময়, নির্ব্বাণবাদী, অহিংসাত্মা, দুর্বোধ্য ধর্ম্ম শাক্যসিংহ এবং তাঁহার শিষ্যগণ সমগ্র ভারতবর্ষকে — গৃহস্থ, পরিব্রাজক, পণ্ডিত, মূর্খ, বিষয়ী, উদাসীন, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, সকলকে শিখাইয়াছিলেন। লোকশিক্ষার কি উপায় ছিল না? শঙ্করাচার্য্য সেই দৃঢ়বদ্ধমূল দিগ্বিজয়ী সাম্যময় বৌদ্ধধর্ম্ম বিলুপ্ত করিয়া আবার সমগ্র ভারতবর্ষকে শৈবধর্ম্ম শিখাইলেন— লোকশিক্ষার কি উপায় ছিল না? সেদিনও চৈতন্যদেব সমগ্র উৎকল বৈষ্ণব করিয়া আসিয়াছেন। লোকশিক্ষার উপায় কি ছিল না? আবার এদিকে দেখি, রামমোহন রায় হইতে কালেজের ছেলের দল সাড়ে তিনপুরুষ ব্রাহ্মধর্ম্ম ঘুষিতেছেন। কিন্তু লোকে ত শেখে না। লোকশিক্ষার উপায় ছিল, এখন আর নাই।
“একটা লোকশিক্ষার উপায়ের কথা বলি—সেদিনও ছিল—আজ আর নাই। কথকতার কথা বলিতেছি। . . . সে কথক কোথায় গেল? কেন গেল? বঙ্গীয় নব্য যুবকের কুরুচির দোষে। গুল্কি কাওরাণী শুয়ার চড়াইতে অপারগ হইয়া কুপথ অবলম্বন করিয়াছে। তাহার গান বড় মিষ্ট লাগে, কথকের কথা শুনিয়া কি হইবে? . . . চল ভাই, ব্রান্ডি টানিয়া থিয়েটারে গিয়া কাওরাণীর টপ্পা শুনিয়া আসি। এই অল্প ইংরেজীতে শিক্ষিত, স্বধর্ম্মভ্রষ্ট, কদাচার, বঙ্গীয় যুবকের গুণে লোকশিক্ষার উপায় ক্রমে লুপ্ত ব্যতীত বর্দ্ধিত হইতেছে না। শিক্ষিত, অশিক্ষিতের হৃদয় বুঝে না। শিক্ষিত, অশিক্ষিতের প্রতি দৃষ্টিপাত করে না। মরুক্ রামা লাঙ্গল চষে, আমার ফাউল কারি সুসিদ্ধ হইলেই হইল। রামা কিসে দিনযাপন করে, কি ভাবে, তার কি অসুখ, তার কি সুখ, তাহা নদের ফটিকচাঁদ তিলার্দ্ধ মনে স্থান দেয় না। বিলাতে কানা ফসেট্ সাহেব, এদেশে সার অস্লি ইডেন, ইঁহারা তাঁহার বক্তৃতা পড়িয়া কি বলিবেন, নদের ফটিকচাঁদের সেই ভাবনা। . . . ছয় কোটি ষাটি লক্ষের ক্রন্দনধ্বনিতে আকাশ যে ফাটিয়া যাইতেছে—বাঙ্গালার লোক যে শিখিল না। বাঙ্গালার লোক যে শিক্ষিত নাই, ইহা সুশিক্ষিত বুঝেন না।”
সেই যুগেই বঙ্কিমচন্দ্রের যা উপলব্ধি তার সারমর্ম—
1. বিদ্যালয়ে বই পড়িয়ে, ব্যাকরণ, জ্যামিতি শিখিয়ে সাত কোটি বাঙালির শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, এবং সেসব শিক্ষা শিক্ষাই নয়। সমাজের সঙ্গে শিক্ষার আত্মিক যোগ থাকা চাই।
2. সাড়ে তিনপুরুষ পরেও ব্রাহ্মধর্ম তথা বাংলার নবজাগরণের আলোক শিখা বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়ায়নি। শুধুই শিক্ষিত কলেজ পড়ুয়ারা বাগ্বিতণ্ডায় ব্যস্ত থেকেছেন।
3. বাইরে থেকে এনে ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বাংলার নিজস্ব যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তা ক্রমশ ধ্বংস হয়েছে।
4. নিম্নতর সমাজকে ভুলে, তার মানুষকে ভুলে শিক্ষা ক্রমশ উচ্চতর সমাজে আবদ্ধ হয়েছে, যাকে আমরা বলি ‘এলিটিস্ট এডুকেশন’। (আজকের ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটি’-র ভাবনায় সেই প্রবণতাই আরও প্রবল।)
আমাদের বর্তমান শিক্ষাপ্রসঙ্গে দিকনির্দেশ পাওয়ার আশায় এরপর শরণাপন্ন হলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের। সম্প্রতি তাঁর সার্ধশতবর্ষ পালিত হল। শুধু জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিনও আমরা উদ্যাপন করলাম সরকারিভাবে স্টেডিয়ামে গানের আসর বসিয়ে। তাই আশা হয়, তাঁর বলা কথা হয়তো কর্তাব্যক্তিরা শুনলেও শুনতে পারেন, যা বলার দুঃসাহস এই অধম গরীব গেঁয়ো শিক্ষকের নেই, আর বললেই বা তাঁরা শুনবেন কেন। বেশি নয়, মাত্র দু’টি প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি। বর্তমান প্রসঙ্গ টেনে মাঝে মাঝে বন্ধনীতে কিছু মন্তব্য রাখলাম—হাজার হোক শিক্ষক তো, তাই মন্তব্য করার লোভ সামলানো মুশকিল।
‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে ১৯০৬ সালে (বঙ্গাব্দ ১৩১৩) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন — “জাতীয় শিক্ষাপরিষৎ শুধু যদি কারুবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইত তাহা হইলে বুঝিতাম যে, একটা বিশেষ সংকীর্ণ প্রয়োজন সাধন করাই ইহার উদ্দেশ্য। কিন্তু যখন দেখা যাইতেছে সাধারণত দেশের সমস্ত শিক্ষার প্রতি পরিষৎ দৃষ্টি রাখিতে চান তখন এই জিজ্ঞাসা মনে উঠে যে, কোন্ ভাবে এই শিক্ষাকার্য চলিবে। কোন্ নিয়মে চলিবে এবং কী কী বই পড়ানো হইবে, সে-সমস্ত বাহিরের কথা। ইহার উত্তরে যদি কেহ বলেন, ‘জাতীয়’ ভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তবে প্রশ্ন উঠিবে, শিক্ষা সম্বন্ধে ‘জাতীয়’ ভাব বলিতে কী বুঝায়? ‘জাতীয়’ শব্দটির কোনো সীমানির্দেশ হয় নাই, হওয়াও শক্ত। [একের পর এক ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি, এক গুচ্ছ ন্যাশনাল কমিশন, ইত্যাদি তো হয়েই চলেছে] . . . যদি ভুল করি — যেটা হাতের কাছেই আছে, আমরা যেটাতে অভ্যস্ত, জড়ত্ববশত যদি সেইটেকেই সত্য মনে করি, তবে বড় বড় নাম আমাদের বিফলতা থেকে রক্ষা করিতে পারিবে না। [এদিকে বড় বড় নামের স্রোত যে অবিশ্রান্ত—কনটিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট, স্টেক হোল্ডারস, মডিউলার ইউনিটাইজড কোর্স, ক্রেডিট, ওয়ার্কবুক অ্যাপ্রোচ, অ্যাক্টিভিটি, অ্যাসাইনমেন্ট, গ্রেড পয়েন্ট, পার্সেন্টাইল, ইত্যাদি] . . .
“য়ুরোপে মানুষ সমাজের ভিতরে থাকিয়া মানুষ হইতেছে, ইস্কুল তাহার কথঞ্চিৎ সাহায্য করিতেছে। লোকে যে বিদ্যা লাভ করে সে বিদ্যাটা সেখানকার মানুষ হইতে বিচ্ছিন্ন নহে। . . . এই জন্য সেখানকার বিদ্যালয় সমাজের সঙ্গে মিশিয়া আছে, তাহা সমাজের মাটি হইতেই রস টানিতেছে এবং সমাজকেই ফলদান করিতেছে। কিন্তু বিদ্যালয় যেখানে চারিদিকের সমাজের সঙ্গে এমন এক হইয়া মিশিতে পারে নাই— যাহা বাহির হইতে সমাজের উপর চাপাইয়া দেওয়া তাহা শুষ্ক, তাহা নির্জীব, তাহার কাছ হইতে যাহা পাই কষ্টে পাই, এবং সে বিদ্যা প্রয়োগ করিবার বেলা সুবিধা করিয়া উঠিতে পারি না। [বাইরে থেকে সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগ ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ, সার্ভিস কমিশন দ্বারা নিয়োজিত স্থানীয় সমাজ-বহির্ভূত শিক্ষক, বোর্ড নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ও পঠনপাঠন, এসব দিয়ে আমরা কতটা কী শিখব?] ।
“. . . এই জন্যই বলিতেছি, য়ুরোপের বিদ্যালয়ের অবিকল বাহ্য নকল করিলেই আমরা যে সেই একই জিনিস পাইব এমন নহে। এই নকলে সেই বেঞ্চি, সেই টেবিল, সেই প্রকার কার্যপ্রণালী সমস্তই ঠিক মিলাইয়া পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা আমাদের কাছে বোঝা হইয়া ওঠে। . . . অতএব বিলাতের নজির একেবারে ছাড়িতে হইবে; কারণ, বিলাতের ইতিহাস, বিলাতের সমাজ আমাদের নহে। [তাই কী? যাবতীয় ওয়ার্ল্ড ক্লাস তো বিদেশেই, যা আমাদের পরম লক্ষ্য, আর বিদ্যালয় বলতে আমরা তো আজও ওই নকলটাই বুঝি] আমাদের দেশের লোকের মনকে কোন্ আদর্শ বহু দিন মুগ্ধ করিয়াছে, আমাদের দেশের লোকের হৃদয়ে রসসঞ্চার হয় কিসে, তাহা ভালো করিয়া বুঝিতে হইবে। বুঝিবার বাধা যথেষ্ট আছে। আমরা ইংরেজি স্কুলে পড়িয়াছি, যে দিকে তাকাই ইংরেজের দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ। ইহার আড়ালে আমাদের দেশের ইতিহাস, আমাদের স্বজাতির হৃদয় অস্পষ্ট হইয়া আছে।
“. . . বিলাতের কোন্ কলেজে কোন্ বই পড়ানো হয় এবং তাহার নিয়ম কী, ইহা লইয়া তর্কবিতর্কে কালক্ষেপ করা সময়ের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার নহে। এ সম্বন্ধে আমাদের হাড়ের মধ্যে একটা অন্ধ সংস্কার প্রবেশ করিয়াছে। যেমন তিব্বতী মনে করে যে লোক ভাড়া করিয়া তাহাকে দিয়া একটা মন্ত্রলেখা চাকা চালাইলেই পুণ্যলাভ হয়, তেমনি আমরা মনে করি কোনোমতে একটা সভা স্থাপন করিয়া কমিটির দ্বারা যদি সেটা চালাইয়া যাই তবেই আমরা ফললাভ করিব। বস্তুত সেই স্থাপন করাটাই যেন লাভ। [কাকস্য পরিবেদনা—কেমন করে যেন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে ওঠে, উপলক্ষের আয়োজনে লক্ষ্য যায় হারিয়ে]
“একদিন তপোবনে ভারতবর্ষের গুরুগৃহ ছিল, এইরূপ একটা পুরাণকথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। . . . যে কালে এই সকল আশ্রম সত্য ছিল সে কালে তাহারা ঠিক কিরূপ ছিল তাহা লইয়া তর্ক করিব না, করিতে পারিব না। কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে, এই সকল আশ্রমে যাঁহারা বাস করিতেন তাঁহারা গৃহী ছিলেন এবং শিষ্যগণ সন্তানের মতো তাঁহাদের সেবা করিয়া তাঁহাদের নিকট হইতে বিদ্যা গ্রহণ করিতেন। এই ভাবটাই আমাদের দেশের টোলেও আজ কতকটা পরিমাণে চলিয়া আসিয়াছে। এই টোলের প্রতি লক্ষ করিলেও দেখা যাইবে, চতুষ্পাঠীতে কেবলমাত্র পুঁথির পড়াটাই সবচেয়ে বড় জিনিস নয়, সেখানে চারিদিকেই অধ্যয়ন-অধ্যাপনার হাওয়া বহিতেছে। [লক্ষণীয়, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো রবীন্দ্রনাথও দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা যা ছিল, তার গুরুত্ব উল্লেখ করছেন।)
“আমরা যাঁহাকে ইস্কুলের শিক্ষক করি তাঁহাকে এমন করিয়া ব্যবহার করি [দোষটা তাহলে শিক্ষকের নয়, যাঁরা তাকে নিয়োজিত করে চালান বা ব্যবহার করেন তাঁদের] যাহাতে তাঁহার হৃদয়মনের অতি অল্প অংশই কাজে খাটে — ফোনোগ্রাম যন্ত্রের সঙ্গে একখানা বেত এবং কতকটা পরিমাণ মগজ জুড়িয়া দিলেই ইস্কুলের শিক্ষক তৈরি করা যাইতে পারে। [রবীন্দ্রনাথ কী বলতেন, আজকের এই অনলাইন ভার্চুয়াল লার্নিং দেখে?] . . . আজকাল প্রয়োজনের নিয়মে শিক্ষকের গরজ ছাত্রের কাজে আসা . . . শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তাঁহার ব্যবসা। তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনিতে পারে, কিন্তু তাঁহার পণ্য তালিকার মধ্যে স্নেহ, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা, প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন — এইখানেই ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ। [অর্থাৎ, শিক্ষাকে স্থানীয় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে ফেললে শিক্ষার পণ্যায়নই ঘটে]
“এবারে বাংলাদেশের বিদ্যাল্যগুলির ‘পরে রাজচক্রের শনির দৃষ্টি [বিশেষ লক্ষণীয়] পড়িবামাত্র কত প্রবীণ এবং নবীন শিক্ষক জীবিকালুব্ধ শিক্ষকবৃত্তির কলঙ্ককালিমা নির্লজ্জভাবে সমস্ত দেশের সম্মুখে প্রকাশ করিয়াছেন তাহা কাহারও অগোচর নাই। . . . লেখাপড়া শেখানো বলিতে আমরা আজকাল যাহা বুঝি তাহার জন্য বাড়ির গলির কাছে যে-কোনো একটা সুবিধামতো ইস্কুল এবং তাহার সঙ্গে বড় জোর একটা প্রাইভেট টিউটর রাখিলেই যথেষ্ট। কিন্তু এইরূপ ‘লেখাপড়া করে যেই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’ [প্রণেতা মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), ব্রিটিশ শাসনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী] শিক্ষার দীনতা ও কার্পণ্য মানবসন্তানের পক্ষে যে অযোগ্য তাহা আমি এক প্রকার ব্যক্ত করিয়াছি।
“অতএব আশঙ্কা হয় আমরা ‘জাতীয় শিক্ষাপরিষৎ রচনা করিবার সময় নিজের দেশ নিজের ইতিহাস ছাড়া সর্বত্রই নজির খুঁজিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া আরো একটা ছাঁচে-ঢালা কলের ইস্কুল তৈরি করিয়া বসিব। . . . আর যেখানে কেবল পুঁথি ও মাস্টার, সেনেট ও সিন্ডিকেট, ইঁটের কোঠা ও কাঠের আসবাব, সেখানে আজও আমরা যত বড়ো হইয়া উঠিয়াছি, কালও আমরা তত বড়োটা হইয়াই বাহির হইব।”
রবীন্দ্রনাথ যে লিখলেন, “এবারে বাংলাদেশের বিদ্যাল্যগুলির ‘পরে রাজচক্রের শনির দৃষ্টি” তার বৃত্তান্তটা কী? খানিকটা আন্দাজ পাওয়া গেল ‘শিক্ষাসংস্কার’ নামে তাঁরই আরেকটা লেখায় (১৯০৬, বঙ্গাব্দ ১৩১৩)। এই প্রবন্ধের আরম্ভে তিনি আয়ারল্যান্ডের শিক্ষাসংকটের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, সপ্তম শতাব্দী থেকে ইউরোপের অন্ধকার যুগে একমাত্র আয়ারল্যান্ডেই বিদ্যাচর্চা চলত। বহু দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসত ও ব্যবস্থাটা ছিল “কতকটা আমাদের দেশের টোলের মতো আর কি।” ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই এই আইরিশ শিক্ষকেরা শিক্ষাবিস্তার করেছিলেন। অষ্টম শতাব্দীতে প্যারিস ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠার ভার পেয়েছিলেন আইরিশ পণ্ডিত ক্লেমেন্স। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। প্রাচীন আইরিশ বিদ্যালয়ে ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্রু ভাষা শেখানো হলেও শেখানোর ভাষা ছিল আইরিশ (মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষাশিক্ষা)। সমসাময়িক বিজ্ঞানও শেখানো হতো আইরিশ ভাষাতেই। ভাষার পারিভাষিক দৈন্য ছিল না। এরপর ইংরেজরা আয়ারল্যান্ড আক্রমণ করে ও এইসব বিদ্যালয়ে আগুন লাগিয়ে বিপুলসঞ্চিত পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দেয়। তাহলেও, যুদ্ধের থেকে দূরে আয়ারল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই শিক্ষাকার্য চলেছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “অবশেষে এলিজাবেথের কালে . . . আয়রলণ্ডের স্বায়ত্ত বিদ্যা ও বিদ্যালয় একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।
“এইরূপে আয়রলণ্ডবাসীরা জ্ঞানচর্চা হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিল, তাহাদের ভাষা নিকৃষ্ট সমাজের ভাষা বলিয়া অবজ্ঞা প্রাপ্ত হইতে থাকিল। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘ন্যাশনাল স্কুল’ প্রণালীর সূত্রপাত হইল। . . . আইরিশদের জোর করিয়া স্যাক্সনের ছাঁচে ঢালা ও ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল স্কুল-প্রণালীর মতলব ছিল। . . . ভালোই বলো আর মন্দই বলো, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন রকম করিয়া গড়িয়াছেন যে, এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাপছাড়া হইয়া যায়।
“যে সময়ে এই শিক্ষাপ্রণালীর প্রবর্তন করা হয়, তখন আয়রলণ্ডের শতকরা আশীজন লোক আইরিশ ভাষায় কথা কহিত। যদি শিক্ষা দেওয়াই ন্যাশনাল বোর্ডের উদ্দেশ্য হইত, তবে আইরিশ ছাত্রদিগকে আগে নিজেদের ভাষায় পড়িতে শুনিতে শিখাইয়া তাহার পরে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে তাহাদিগকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা না করিয়া নানাপ্রকার কঠিন শাস্তিদ্বারা বালকদিগকে তাহাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করিতে একেবারে নিরস্ত করিয়া দেওয়া হইল। [কী আশ্চর্য, আজও আমাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতেও যে একই নিয়ম! রবি ঠাকুর বললেই বা কী। ]
“শুধু ভাষা নয়, আইরিশ ইতিহাস পড়ানো বন্ধ হইল। আইরিশ ভূবৃত্তান্তও ভালো করিয়া শেখানো হইত না। ছেলেরা বিদেশের ইতিহাস ও ভূবৃত্তান্ত শিখিয়া নিজের দেশ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিত। ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশ-ভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া। . . . . আয়রলণ্ডের শিক্ষাসংকটের কথা আলোচনা করিয়া দেখিলে একটা গভীর জায়গায় আমাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। . . .
“আর একটি কথা। শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি আর-কোনো অবান্তর উদ্দেশ্য ভিতরে ভিতরে থাকিয়া যায় তবে তাহাতে বিকার জন্মায়। আইরিশকে স্যাক্সন করিবার চেষ্টায় তাহার শিক্ষাকেই মাটি করা হইয়াছে। কর্তৃপক্ষ আজকাল আমাদের শিক্ষার মধ্যে পোলিটিক্যাল মতলবকে সাঁধ করাইবার চেষ্টা করিতেছেন তাহা বুঝা কঠিন নয়। . . . শিক্ষাকে তাঁহারা শাসনবিভাগের আপিস-ভুক্ত করিয়া লইতে চান। . . .
“নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে, এমনতরো মানুষ তৈরি করিবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজের যোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ। . . . এখন বিদ্যাশিক্ষাকে যেমন করিয়া হউক নিজের হাতে গ্রহণ করিতেই হইবে। “. . . আমরা গবর্মেন্টের সম্মতির অধীনে যখন বাহ্যস্বাতন্ত্র্যের একটা বিড়ম্বনা লাভ করি তখনি আমাদের বিপদ সবচেয়ে বেশী। তখন প্রসাদলব্ধ সেই মিথ্যা স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যাহা দিতে হয় তাহাতে মাথা বিকাইয়া যায়। . . . শিক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য-চেষ্টার দিন আসিয়াছে এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব . . . ইহা নিশ্চয়।”
কীভাবে শিক্ষার এই সদুপায় আমরা নিজেরা উদ্ভাবন করব ও উদ্যোগ নেব? এই প্রশ্নে দেখলাম, গুরুদেবও একই পন্থা নিয়েছেন, যে পন্থা নিয়ে এই অধম নিজে বলার দুঃসাহস না করে এত লম্বা লম্বা উদ্ধৃতি রাখছে। রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেছেন টলস্টয়কে। লিখেছেন, “বর্তমানকালে যে একটিমাত্র সাধক য়ুরোপে গুরুর আসনে বসিয়া নিরন্তর অরণ্যে রোদন করিয়া মরিতেছেন সেই টল্স্টয় রুশিয়ার শিক্ষানীতি সম্বন্ধে যে কথা বলিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদধৃত করি।” রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃতিটি ইংরেজিতেই রেখেছেন। স্বভাবতই, উদ্ধৃতিতে সেটাই করণীয়। তাহলেও, সাহস করে সেটিকে বাংলায় রাখি—
“আমার মনে হয় এটা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ যে যা উচিত তা আমরা সন্তর্পণে শান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে করে যাব, সরকারের অনুমতি ভিক্ষা তো নয়ই, বরং সচেতন ভাবে সরকারকে এড়িয়ে। মানুষের অজ্ঞানতাই হল সরকারের ক্ষমতা এবং সরকার সেটা জানে ও তাই সে সর্বদাই জ্ঞানবিকাশে বাধা দেবে। এই সত্যটা বোঝাই আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন। সবচেয়ে বিপজ্জনক হল সরকারকে এমন ধারণা তৈরি করতে দেওয়া যে সে যেন মানুষের অজ্ঞানতা দূর করতে ব্যস্ত, যখন সে আসলে মানুষকে অন্ধকারেই ঠেলে দিচ্ছে। এই কাজটা সে করছে যাবতীয় মেকী-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন স্কুল, হাইস্কুল, ইউনিভার্সিটি, যেগুলি সে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তার সাথে যাবতীয় কমিটি, কংগ্রেস ইত্যাদির সাহায্যে। . . . এটা আমার কাছে খুবই দুঃখজনক লাগে যখন দেখি যে বহু মূল্যবান, নির্লিপ্ত এবং নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। এটাই অবাক করে যে বহু সৎ ও জ্ঞানী মানুষের শক্তিক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলনে, যে আন্দোলন সরকারেরই বেঁধে দেওয়া আইন, যা সরকার চায়, তারই পথে প্রবাহিত হচ্ছে।”
আমার উদ্ধৃতি দেওয়ার পালা শেষ। টলস্টয়ের বক্তব্যটি বিবেচনাসাপেক্ষে অতি-বিপ্লবী মনে হতে পারে, বিশেষত বর্তমানকালে যখন দেশে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার আছে। কিন্তু দিগ্নির্দেশ একটা আছে—সন্তর্পণে মিডিয়াকে এড়িয়ে, সরকার-বেসরকারকে এড়িয়ে, ঢাক-ঢোল না পিটে শান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শিক্ষার সদুপায়টির উদ্ভাবন ও উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরকেই । যাইহোক, সান্ত্বনা পেলাম অন্য কারণে। বুঝলাম, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও তস্য গুরু টলস্টয়, সকলেই আজও ‘নিরন্তর অরণ্যে রোদন করিয়া মরিতেছেন’। তাহলে আমি আর এমন কোন্ হতভাগ্য? শিক্ষা নিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, সে আমার পাগলামো, বুদ্ধিহীনতার রোগ।
অবজ্ঞার অতীত
প্রশ্ন একটা রয়েই গেল। কী ছিল, কেমন ছিল, কতটা বিস্তৃত ছিল আমাদের সেই শিক্ষার উপায়, যা ইংরেজি স্কুল শিক্ষার চাপে ধ্বংস হয়ে গেছে বলে বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করেছেন, অথবা সেই বিদ্যালয়গুলি যার ওপর রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘রাজচক্রের শনির দৃষ্টি’ পড়েছিল? এই প্রশ্ন আমাদের প্রচলিত ইতিহাসের আলোচনাতেই গুরুত্ব পায় না; সাধারণের তো এবিষয়ে জানার সুযোগই নেই। স্কুল পাঠ্যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলে একটা পাঠ অবশ্য আছে, যেখানে উল্লেখ থাকে ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কয়েকটি মঙ্গলকাব্যের। কিন্তু যে বিদ্যাশিক্ষার বনিয়াদে এই সাহিত্য সৃষ্টি ও চর্চা হতে পেরেছিল তার হদিশ মেলে না। আলোচনার শুরুই হয় রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের হাত ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা রেনেইসান্স-য়ের কথা নিয়ে। তথাকথিত শব্দটা ব্যবহার করতে হল, কারণ ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ আদৌ কতটা নবজাগরণ ছিল, সে নিয়ে পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ্দের মধ্যে বিতর্ক দেখা গেছে।
এই নবজাগরণ কালের প্রারম্ভ থেকে আমাদের যে শিক্ষার ইতিহাস তা মূলত কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর ব্রিটিশ সরকার অনুমোদিত স্কুল-কলেজগুলিকে ঘিরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ১৮১৩ সালের রয়্যাল চার্টারে অনুমতি দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে (Royal Charter 1813)। সেই থেকে শুরু হল দেশীয় বিদ্যালয়গুলির ওপর ‘রাজচক্রের শনির দৃষ্টি’। এরপর ক্রমান্বয়ে আসে ১৮২৩ সালে জেনেরাল কমিটি অভ পাবলিক ইন্স্ট্রাকশন (general committee of public instructions), ১৮৩৫ সালে ওই কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত মেকলে সাহেবের শিক্ষানীতি (English Education Act, 1835) , ও ১৮৫৪ সালে উড’স ডেসপ্যাচে (Wood’s Dispatch)মেকলের শিক্ষানীতি রূপায়নের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা আর সেই মতো প্রতিষ্ঠা হয় ডাইরক্টরেট অভ পাবলিক ইন্স্ট্রাকশন (ডিপিআই), যে ব্যবস্থা আজও বিদ্যমান। সরকার অনুমোদিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটা ব্রিটিশদেরই তৈরি করে দেওয়া, ওই উড’স ডেসপ্যাচ থেকে।
সরাসরি সরকার পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনুমোদিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রান্ট-ইন-এড নিয়ে টানাপোড়েন সেই সময়েই দেখা গিয়েছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান সমস্যাগুলি নতুন কিছু নয়, জন্মলগ্ন থেকেই এগুলি প্রকট হয়েছিল। এর খানিকটা আন্দাজ মেলে অনিল শীলের ‘দ্য ইমারজেন্স অভ ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’ (১৯৬৮) বইটাতে । অর্থাৎ সার্ধশত বছর হল আমরা সেই একই সমস্যা নিয়ে একই ভাবে ঘুরপাক খেয়েই চলেছি।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের আলোচনা ও গবেষণার প্রারম্ভিক বিন্দু মেকলের শিক্ষানীতি ও উড’স ডেসপ্যাচ। এর আগের ব্রিটিশ শাসনপূর্ব দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস গবেষণায় আসে না তেমন। পাঠ্যপুস্তকে বড়জোর সেই আদিকালের তক্ষশীলা, নালন্দা, আর টোল, পাঠশালা, চতুষ্পাঠী ইত্যাদি উল্লেখ করে চলে আসা হয় নবজাগরণ কালে। অনিল শীলের বইটাতে কিছু তথ্যসহ আলোচনা আছে নবজাগরণ কাল বা মেকলের শিক্ষানীতির সময় থেকে শিক্ষাব্যবস্থাটির মূল প্রবণতার — শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা কীভাবে ক্রমশ শহরের ‘ভদ্রলোকদের’ মুঠোয় চলে এসেছিল। শহরে ‘ভদ্রলোকদের’ ইংরেজি শিক্ষার জোয়ারে যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তাতে স্বভাবতই দেশীয় শিক্ষাকে দেখা হয়েছিল নিতান্তই গেঁয়ো টুলো পণ্ডিতদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাণ্ডকারখানা হিসাবে। এই অবজ্ঞার কারণেই, যেমনটা ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনে আইরিশদের ভাগ্যে, আমাদেরও আগ্রহ হয় না সেই নিকৃষ্ট (?) অতীতকে জানার। যাকে জানলামই না তাকে নিকৃষ্ট বা উৎকৃষ্ট বলি কী করে? একেই বলে দেগে দেওয়া।
ইংরেজি শিক্ষার আলোকে সদ্য শিক্ষিত শহরের উচ্চ সম্প্রদায়ের ‘ভদ্রলোকেরা’ যে নিজের অতীতকেই নিকৃষ্ট প্রমাণ করতে ব্যগ্র হবে সে নাহয় বোঝা যায়। বোঝা যায় না গরীবমানুষের কথা বলা কমিউনিস্ট পার্টিকে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিবেচনায় ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ যে গুরুত্বপূর্ণ প্রগতি ও আধুনিকতা এনেছে তার আলোচনা স্থান পেয়েছে, ‘নোটস্ অন বেঙ্গল রেনেইসান্স’ (১৯৪৬) (Bengal Renaissance) । সে নাহয় হল। স্বয়ং কার্ল মার্ক্স (১৮১৮–১৮৮৪) ভারতে ব্রিটিশ শাসন (The British Rule in India) নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলেন (নিউ ইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন, ২৫ জুন, ১৮৫৩) তাতে ভারতীয় গ্রামীণ সমাজকেন্দ্রিক সভ্যতা বা ব্যবস্থার কপালে জুটেছিল ভয়ানক অবজ্ঞা —
যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবার ও গ্রামকেন্দ্রিক এক ব্যবস্থার অচলায়তন, যেখানে আছে আধা-বর্বর, আধা-সভ্য, অর্ধউলঙ্গ কিন্তু স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত, অন্ধকার কুসংস্কারে কূপমণ্ডূক মানুষ যারা নতজানু হয় হনুমান নামে একটি মর্কট ও শবলা নামে একটি গাভীর সামনে। মার্ক্স লিখলেন বটে, কিন্তু একথা ঠিক যে তাঁর পক্ষে এদেশ সম্বন্ধে বিস্তৃত জানা সম্ভব ছিল না। তাঁরই সমসময়ে ফকির লালন শাহ (১৭৭৪–১৮৯০) (Lalon Shah) এদেশের মাঠেঘাটে ঘুরে যে সমস্ত গান বেঁধেছিলেন তাঁর দর্শনের খবর জানলে হয়তো মার্ক্স একটু অন্য রকম ভাবতেন। মার্ক্সের সিদ্ধান্ত, ব্রিটিশ শাসন আর যাই হোক ভারতের ভূ-পৃষ্ট জলের সেচ ব্যবস্থা, কৃষি ও বস্ত্রশিল্প এবং বস্ত্রশিল্পের সুবিখ্যাত নগরগুলিকে ধ্বংস করে একটি অতি মহৎ কর্ম সাধন করেছে, এনেছে এশিয়ার সর্বপ্রথম সমাজবিপ্লব।
মার্ক্সের সিদ্ধান্ত যাই হোক, এই লেখাতেই মার্ক্স আরও যেসব কথা উল্লেখ করেছেন তার গভীরে গিয়ে দেখলেই (ইংরেজিতে বলে, ‘রীড বিটুইন দ্য লাইন্স’) আমরা যা পাই তা ভাববার বিষয়ই বটে—
1. যুগ-যুগান্ত ধরে (টাইম ইম্মেমোরিয়াল) চলে আসা ব্যবস্থা। অর্থাৎ ব্যবস্থাটা নিশ্চয় প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থেকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছিল। তা নাহলে কবে মুছে যেত। আর এই কাজটা পারেনি বলেই আমাদের বর্তমান ইউরোপীয় শিল্পসভ্যতা মাত্র দু’শ বছরের মধ্যেই আজ প্রকৃতির রোষে ধ্বংসের পথে।
3. দেশের শাসনক্ষমতায় রাজা-বাদশা কে এল কে গেল তা নিয়ে এই ব্যবস্থা বিপর্যস্ত বা অশান্ত হয় না। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তক্ষেপের বাইরে ছিল এই ব্যবস্থা।
4. সরকারের কাজ নির্দিষ্ট গণ্ডীতে বাঁধা — শুল্ক আদায়, বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ ও যুদ্ধ, আর খাল-বিল, নদী-নালার সংস্কারে সেচব্যবস্থা বা পাবলিক ওয়ার্কস। বাকি সব স্থানীয় গ্রামসমাজের হাতে। অতএব, সব দিক থেকেই বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা — রাজনীতি বা অর্থনীতি।
5. ইউরোপের কৃষি আবহাওয়া-নির্ভর। কিন্তু এই ব্যবস্থা তা নয়। কৃষি এখানে ভূপৃষ্ঠের সেচ-জল নির্ভর। বন্যার জল ধরে রাখা ও বন্যা পরবর্তী পলিমাটিতে চাষ করার পদ্ধতি এই ব্যবস্থার আয়ত্তে ছিল।
6. সেচ-জল ব্যবহারের সর্বজনীন ব্যবস্থা। গ্রামের জলাশয়ের জলের কোনও মালিকানা নয়, সকলের ব্যবহারে (কমন ইউস) জল ছিল সমবায় বা ভলান্টারি ব্যবস্থায়।
7. তৎকালীন বিশ্বের বিখ্যাত বস্ত্রশিল্প, স্বর্ণশিল্প, ও সমুদ্রবাণিজ্য এবং বাণিজ্যনগরও ছিল যার মারফৎ এদেশে সোনা আসত ইউরোপ থেকে। তাহলে সবটাই অন্ধকার কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আধা বর্বর কূপমণ্ডূক মানুষ, কোনও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ছিল না ভাবাটা কঠিন। এমনটাও ভাবা কঠিন যে গ্রামীণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, পণ্য কেনাবেচা হতো না।
অবজ্ঞার অতীত প্রসঙ্গে এসব কথা এসে পড়ল। কিন্তু এগুলি অন্য আলোচনার বিষয়। ইংরেজি শিক্ষার আলোকে ‘নবজাগরণ’ আমাদের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গীতে যে অচলায়তন তৈরি করেছে তাকে ভাঙা সহজ নয়। কিন্তু নিজেদের ইতিহাস, নিজেদের ভূ-বৃত্তান্ত, নিজেদের বাস্তুতন্ত্র না জেনে শিকড়হীন, গ্রন্থিহীন অস্তিত্ব নিয়ে আর বোধহয় বেশি দিন চলা যাবে না। তাছাড়া অতীতকে নিকৃষ্ট বলে আলোচনাতেই স্থান না দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন টুকরো টুকরো অংশে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার হাতে।
ফিরে আসা যাক শিক্ষা প্রসঙ্গে। কী ছিল ব্রিটিশ শাসনপূর্ব আমাদের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা? এ বিষয়ে জানার তেমন কোনও উপায় নেই, উইলিয়াম অ্যাডাম-য়ের তিনটি রিপোর্ট ছাড়া। যদিবা কিছু তথ্য মিলতে পারত দেশীয় পুঁথিপত্রে কিন্তু তার অধিকাংশ ধ্বংস করা হয়েছে, আর ধ্বংস হয়েছে অনাদরে। এক সাহেবেরই করা ওই তিনটি রিপোর্টেই যা কিছু তথ্য পাওয়া যায়। উইলিয়াম অ্যাডাম (১৭৯৬—১৮৮১), হারভারড প্রফেসর, অবশ্য ব্রিটিশ নন, স্কটিশ। মেকলের সময়ে জেনেরাল কমিটি অভ পাবলিক ইন্স্ট্রাকশন তাঁকে নিয়োগ করেছিল ভারতের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা জরীপ করে রিপোর্ট দেওয়ার কাজে। অ্যাডাম তিনটি খণ্ডে তাঁর রিপোর্ট (এডুকেশন সার্ভে অভ বেঙ্গল, ১৮৩৫–৩৮) জমা দেন ও সুপারিশ করেন, সরকার ও মিশনারিদের নতুন করে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে শিক্ষার উন্নতি সাধনে বিস্তৃত দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাকেই চালিয়ে যাওয়ার। তাঁর এই প্রস্তাব ও সুপারিশ বাতিল করা হয় ১৮৩৯ সালে ও অ্যাডাম পদত্যাগ করেন। বিষয়টা নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে বুঝলাম, ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ আমাদের দৃষ্টিকে এতটাই সংকীর্ণ করেছে যে অ্যাডাম-য়ের রিপোর্ট কোনও গুরুত্বই পায়নি আমাদের দেশীয় শিক্ষার ইতিহাসে।
সম্প্রতি দেখলাম উচ্চশিক্ষিত বাঙালি অবজ্ঞাবশত অনাগ্রহ দেখালেও তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সেই বিহার প্রদেশের একটি সরকারি রিপোর্টে (রিপোর্ট অভ দ্য কমন স্কুল সিস্টেম কমিশন, ২০০৭) অ্যাডাম-য়ের রিপোর্টের উল্লেখ। মদনমোহন ঝাঁ, অনিল সদগোপাল, ও মুচকুন্দ দুবে-র কমিশন মাত্র নয় মাসে সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছে। এই রিপোর্ট তৈরিতে তাঁদের যত্ন ও মুন্সিয়ানা নজর কাড়ে। অ্যাডাম-য়ের ‘এডুকেশন সার্ভে অভ বেঙ্গল’ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে — দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রায় প্রত্যেক গ্রামে বিদ্যালয় ছিল, উন্নতমানের পাঠ্যক্রম ছিল, ছিল পাঠের পুঁথিপত্র। সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চাও ঘটত এই ব্যবস্থায়। বিদ্যালয়গুলি সবই ছিল স্থানীয় গ্রামসমাজের অঙ্গ এবং বহু সময়েই শিক্ষকরা স্ব-উদ্যোগে এর প্রতিষ্ঠা করতেন। অতএব, এসব অতীতের কল্পকথা নয়, তথ্যসমৃদ্ধ সার্ভে রিপোর্টও একটা আছে, ওই সাহেবদেরই করা। ওঁরা নিশ্চয় বাড়িয়ে দেখাবেন না।
এই অতীত হয়তো বাঙালির বিস্মৃত অতীত হয়েই থেকে যাবে। সেই সঙ্গে লুপ্ত হবে ভাবনার ক্ষমতা— যার অতীত হারিয়ে গেছে ঔপনিবেশিক শিল্পসভ্যতায়, তার বর্তমান পথ হারায় ওরই গোলকধাঁধায়, আর ভবিষ্যৎও ঘুরে মরে সেইখানেই। তাই শত কমিটি শত উপদেষ্টা শত মেন্টর খুঁজেও আমরা কি পারব — হোয়াট বিহার ক্যান থিংক টুডে, ক্যান বেঙ্গল থিংক ইট এভার? নাকি, রবীন্দ্রনাথের কথায়, “. . . আমরা মনে করি কোনোমতে একটা সভা স্থাপন করিয়া কমিটির দ্বারা যদি সেটা চালাইয়া যাই তবেই আমরা ফললাভ করিব। বস্তুত সেই স্থাপন করাটাই যেন লাভ।” তাই আমরা উপদেষ্টা আর মেন্টর খুঁজে মরি এইটুকুই জানতে যে শিক্ষা কী ও কেমন করে হবে।
পুনশ্চ: অতীতকে জানার এই চেষ্টার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে। তাই আবার রবীন্দ্রনাথকেই উদ্ধৃত করতে হচ্ছে — “ঠিক সেদিনকে আজ ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিলে সে-ও একটা নকল হইবে মাত্র, তাহার বাহ্য আয়োজন বোঝা হইয়া উঠিবে, কোনো কাজে লাগিবে না।” তাহলে আজ শিক্ষার সদুপায় কী ও তার উদ্যোগ কীভাবে নেওয়া তা আমাদেরকেই বুঝে নিতে হবে।
Reprint: Sharodiyo Ganobarta, 2011
You May Also Like

শিক্ষার ভাষা ও ভাষার শিক্ষা, শিক্ষিতের ভাষা ও মানুষের ভাষা
January 12, 2022
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র — শিক্ষণ পদ্ধতির রূপরেখা
January 3, 2022