Education

শিক্ষার ভাষা ও ভাষার শিক্ষা, শিক্ষিতের ভাষা ও মানুষের ভাষা

বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন এসেছে — আদিবাসী শিশুদের কি ওদের মাতৃভাষায় ও ওদের নিজস্ব লিপিতে পড়ানো হয়? সম্ভবত আদিবাসী বলতে সাঁওতাল ও তাঁদের ভাষালিপি, অল চিকির (১৯২৫ সালে তৈরি) (Ol Chiki script) কথা মাথায় নিয়ে এই প্রশ্ন। প্রশ্নটা আপাত দৃষ্টিতে খুবই সোজাসাপটা ও প্রাসঙ্গিক। কোনও দ্বিমত নেই–মাতৃভাষাই হওয়া উচিৎ শিক্ষার মাধ্যম (learning through mother tongue) এবং সেই ভাষার লিপি ও সেই লিপিতে লেখা পাঠ্যপুস্তক থাকলে তাই দিয়েই লেখাপড়া করা বাঞ্ছনীয়। গ্রামে স্থানীয় দিদিমণিদেরই দিয়েই লেখাপড়া শেখানোর কারণই হল আমাদের নীতি–শিশুকে কোনও বিষয় (যেমন, ধরা যাক, অঙ্ক) শেখানো বোঝানোটা গ্রামের মা-মাসির মতো যত্ন করে দিদিমণিরা করবেন, স্বভাবতই তাঁদের মাতৃভাষায়। এইটুকু হল সোজাসাপটা প্রশ্নের একটা ওপরে ওপরে সহজ উত্তর। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, ব্যাপারটা এত সহজ নয়।

এক পশ্চিমবঙ্গেই ৪০টি তপসিলী আদি জনজাতি আছে, আর কোনও কোনও গ্রামে এঁদের একাধিককে তাঁদের নিজস্ব ভাষা নিয়েই আদি বাসিন্দা হিসাবে পাওয়া যায়। ভাষা বৈচিত্র্যও আছে—সাঁওতালির একটি উপভাষা হল কোঁড়া (বিপন্ন হয়ে পড়ছে) (endangered language)। এছাড়া আছে কুরমালি, পাহাড়িয়া, কামারি-সাঁওতালি, লোহারি-সাঁওতালি। কুর্মি (মাহাত) ভাষাও আছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সাওঁতালি আর বীরভূমের সাঁওতালি ভাষা বলার টানটাই আলাদা। উত্তরবঙ্গে আছে কামতাপুরী, রাজবংশী, ককবরক, নেপালি (তারও বহু রকমফের, লিপিও পাল্টেছে), লেপচা, ভুটিয়া, আরও কত স্থানীয় ভাষা (community languages)। চা-বাগানের শ্রমিক বসতিতে ঠিকই করতে পারা যায়না এখানে কটা ভাষা আর কোনটা মাতৃভাষা। তাহলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কী হবে? সমস্যা আরও গভীর। আমরা কলকাতা বা ঢাকার ভদ্রবিত্ত বাঙালিরা যে প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলি, লেখাপড়া করি, বই লিখি, সেই কি সকল বাঙালির মাতৃভাষা? শ্রীহট্ট বা চট্টগ্রামে এই ভাষায় শিক্ষাদান কী মাতৃভাষার মাধ্যমে বলা হবে? অথচ এও তো ঠিক যে ভাষার একটা মান্য চলিত রূপ না থাকলে সে ভাষায় লেখাপড়া আর এগোয় না, হয়তো কোনও নির্দিষ্টরূপে টিঁকেও থাকে না।

আরও একটা প্রশ্ন এসে পড়ে। শিশু কটা ভাষা শিখবে? কোন্‌টা কবে থেকে? পশ্চিমবঙ্গের ইস্কুলে বাংলা তো অবশ্যপাঠ্য, কারণ এটা যে বাঙালিস্থান। সাথে আছে ইংরেজি। ওটা না শিখলে বাঙালির উচ্চশিক্ষার বাড়াভাতে ছাই পড়বে। এবার ভাবতে হয় সাঁওতাল শিশুর কথা। তাকে শিখতে হয় বাংলা বর্ণগুলো (হরফ) চিনে বাংলা ভাষাটা পড়া ও লেখা শেখা (বলায় তো হবে না, তার তো ওই ভাষা বলার কথা নয়), ইংরেজি বর্ণগুলো চিনে ইংরেজি ভাষাটাও পড়া ও লেখা শেখা ওই একইভাবে, না বলা বাণীতে। কথায় না বলে ও শুনে এভাবে শুধু পড়া ও লেখা দিয়েই ভাষা শিক্ষা হয় কিনা জানি না (foreign language vs second language)।

এখন মাতৃভাষা সাঁওতালির লিপি তৈরি হয়েছে। তাই কি এবার বলতে জানলেও তাকে অল চিকি বর্ণগুলোও চিনে নিতে হবে ওই ভাষায় পড়তে ও লিখতে? কিন্তু এই লিপিতে পশ্চিমবঙ্গের ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তক তো নেই, নেই কোনও মান্য চলিত সাঁওতালি ভাষাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে কিছু গবেষণাপত্র অবশ্য আছে। এই ভাষা বিভ্রাটের — শিক্ষার ভাষা ও ভাষার শিক্ষা (language of education), শিক্ষিতের ভাষা ও মানুষের ভাষা — কী উত্তর তা আমার জানা নেই।

4 July 2021, Phuldanga, Birbhum

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© Sutanu Bhattacharya