বিস্ফোরিত সভ্যতা — সীমার মাঝে অসীমের সন্ধান

পরিবর্তন না ভাঙন?
বিশ্বসংসারে সবকিছুই নাকি পরিবর্তনশীল। প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মে তাই পালাবদল ঘটে, পুরনোর জায়গায় স্থান করে নেয় নতুন। পালাবদলের স্রোতে অতীতের গর্ভ থেকে উঠে আসে বর্তমান, আর বর্তমানই সৃষ্টি করে তার ভবিষ্যৎ যখন সে আর তার নিজের ভার বহন করতে পারে না। আজকাল কিন্তু কেমন যেন খটকা লাগছে। সর্বদা, সর্বত্র এমনটা কি হতেই হবে? প্রকৃতির নিয়ম কি মানুষের কর্মকাণ্ডে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতার ক্ষেত্রেও খাটবে?
আমরা, মানুষেরা এমনিতেই খানিকটা সৃষ্টিছাড়া জীব। আর আজকাল, বিশেষত শহরসভ্যতার বর্তমান স্তরে, আমরা যেন আরও সৃষ্টিছাড়া হয়ে উঠেছি, ও শেষমেশ কেমন যেন নিজেদের কলে নিজেরাই পড়ে গেছি। বর্তমানের অস্তিত্বকেই রক্ষার তাগিদে ক্রমাগত আরও বেশি কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে চলেছি, কর্মকাণ্ডের স্রোতে ভাসছি। থামার কোনও উপায় নেই। তাই বর্তমানটাই কেবল স্ফীত হয়ে উঠছে, হারিয়ে গেছে অতীত, সামনে নেই কোনও ভবিষ্যতের ছবি।
গত তিন দশক যাবত সমাজতাত্ত্বিকেরা লেখাপত্রে বারবারই বলে চলেছেন যে সভ্যতার বর্তমান স্তরে পরিবর্তন ঘটছে অতি দ্রুত, যার চাপে ভেঙে পড়ছে পুরনো ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি মানবিক মূল্যবোধ ও সম্পর্কগুলো। এমনটা যে ঘটছে তা আমরা সকলেই টের পাচ্ছি, যদিও এ নিয়ে ভাবার সময়ই হয় না তেমন, আর ভেবেই বা কী হবে। প্রশ্ন হল, ভেঙে চলেছে সবকিছুই, কিন্তু তার জায়গায় গড়ে উঠছে কি অন্যকিছু? এ কেমন পরিবর্তন, যার অতীত থেকে কোনও ব্যাখ্যা মেলে না, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনও আন্দাজ করা যায় না? টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়া একটা ছবির অংশগুলো নিয়ে আমাদের একদল যেন বিভোর নতুনের স্বপ্নসন্ধানে আর অন্যদল আঁকড়ে ধরেছে অতীতের পূর্ণাঙ্গ ছবিটার স্মৃতি রোমন্থন।
সৃষ্টিছাড়া মানুষের তৈরি সভ্যতাও যেন হয়ে উঠেছে এক অনাসৃষ্টি। খাপ ছাড়া ভাঙা ভাঙা ছবিগুলো যেন আর মেলানো যাচ্ছে না। বড় বড় আবাসন প্রকল্পের বাড়িগুলো —পঞ্চাশ না একশ তলা হবে — কেমন করে একের পর পর এক গড়ে উঠে দানবের মতো আকাশটাকে গিলে খাচ্ছে। শহর জুড়ে উন্নততর সভ্যতার চিহ্ন — ফ্লাইওভার, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মলে থরে থরে সাজানো দেশি-বিদেশি পণ্যসম্ভার। বেশ লাগে এই নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন। কিন্তু একই সাথে খট্কাও যে লাগে। আমাদের চা-বাগান, চটকল, বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক বস্তি, আর আমলাশোল, জলঙ্গির মতো গ্রামে নাকি মানুষ মরছে অনাহার, অর্ধাহার, আর তার ফলে রোগে ভুগে। এ কেমন পৃথিবী?
চাকরিসূত্রে শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারি, আবার কখনোবা উড়োজাহাজে এ-শহর থেকে সে-শহরে যাওয়া-আসা আর বার বার হোঁচট খাওয়া — দুটো জগত যে সম্পূর্ণ আলাদা, তার মানুষেরাও একেবারেই আলাদা।
খাপছাড়া এই ছবিটা সারা বিশ্ব জুড়ে বেড়েই চলেছে। উন্নত বিশ্বের উন্নততম শহরগুলোতে আছে লাখে লাখে রেজিস্টার্ড হোমলেস— মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও এদের নেই। খোদ ওয়াশিংটন শহরেই প্রায় ত্রিশ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। আজ বিশ্বে প্রায় একশ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটায়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থনৈতিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সারা পৃথিবীর আয় বৃদ্ধি আর সেই সাথে ধনসম্পদের বিস্ফোরণ ঘটছে, যাকে অনেকেই আর্থিক সম্পদের বুদ্বু্দ (asset bubble) বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি যে বিস্ফোরণ ঘটছে দারিদ্র্য আর বৈষম্যের — দারিদ্র্যে নিমজ্জিত মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে বেড়েই চলেছে। উন্নতির পীঠস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেই ১৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে। ১৯৮৭ সালে পৃথিবীর ১২০ কোটি মানুষের দৈনিক খরচ ছিল এক ডলার মূল্যের কম। সংখ্যাটা ২০০৩ সালে এসে হয়েছে ১৫০ কোটি ও আন্দাজ হল আগামী দশ বছরে এটা বেড়ে হবে ১৯০ কোটি। এদিকে আয়-বৈষম্যও বাড়ছে। ১৯৬০ সালে পৃথিবীর মানুষের মোট উপার্জনের ৭০ ভাগ ছিল সর্বোচ্চ ধনী ২০ ভাগ মানুষের হাতে। এখন এদের হাতে আছে ৮৫ ভাগেরও বেশী।
উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও আয়-বৈষম্য বেড়ে চলেছে। ছবিটা কোনও ভাবেই মিলছে না। সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে, প্রযুক্তি উন্নত থেকে উন্নততর হয়েই চলেছে, মানুষের উৎপাদন-ক্ষমতাও ক্রমাগতই বাড়ছে। তাহলে এমন ছবি কেন? পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে শিশু হত্যা, শিশু-বেশ্যা, নারী-ধর্ষণ, মাদকদ্রব্য আর অস্ত্রের আন্তর্জাতিক চোরাকারবার। পাশাপাশি বাড়ছে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশ দূষণ, উষ্ণায়ন ও ফলে প্রকৃতির রোষ ও প্রতিশোধ, আর ক্ষয়ে আসছে প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ উন্নয়ন হয়েই চলেছে। পৃথিবী জুড়ে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, উন্নয়নের ডালপালা প্রসারিত হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে শহরসভ্যতা।
১৯৫০-এর দশকে শহরবাসী মানুষের সংখ্যা উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমানে সমানে ছিল — মোটামুটি ত্রিশ কোটি করে। এখন উন্নয়নশীল দেশেই ২০০ কোটি মানুষ শহরবাসী, আর সংখ্যাটা উন্নত দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। উন্নত দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের এই প্রসারণ চমকপ্রদ বটে। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মানের সত্যিই কি উন্নতি ঘটছে? বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টেই আশঙ্কা করা হয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শহরেই দেখা মিলবে পৃথিবীর অধিকাংশ দরিদ্রতম মানুষের। এখনই তো দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরবাসী মানুষের ৬০ শতাংশের বাসগৃহ বা বসবাসের ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই।
উন্নয়নের এই প্রসারণই যেন সৃষ্টি করছে এক অদ্ভুত সঙ্কট—বাড়িয়ে তুলছে মানুষের বিপন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা, আর ভবিষ্যৎকে করছে আরও অনিশ্চিত। উন্নয়নকে পথ করে দিতে মানুষকে হতে হচ্ছে উচ্ছিন্ন—জীবিকা থেকে এমনকি বসবাসের স্থান থেকেও। সৃষ্টি হয়েছে বেড়ে চলা উচ্ছিন্ন মানুষের স্রোত, যার নাম দেওয়া হয়েছে উন্নয়ন-উদ্বাস্তু বা ডেভেলপমেন্ট রেফিউজি। সোনার পাথরবাটির মতো এমন দ্বান্দ্বিক নাম আজকাল আর আমাদের প্রশ্ন জাগে না। মার্কেট ইকনমির পক্ষে সওয়াল করতে বাজারি অর্থনীতিবিদ্রা বলেই দিয়েছেন উন্নয়ন চাইলে অমনটা একটু সইতে হবে। এ যেন নানাবিধ নির্মাণকর্মে রাস্তাঘাট খুঁড়ে, ভেঙেচুড়ে পথচারীদের জন্য বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো—টুডেস পেন টুমরোস গেন। কিন্তু উন্নয়ন-উদ্বাস্তুদের আগামী দিনের সূর্যোদয় কখনোই আর ঘটে না।
অমিলের মিলনেই নাকি মানুষের আনন্দ, দ্বন্দ্ব অবসানে সমাধান খুঁজে পাওয়াতেই তৃপ্তি। কিন্তু এত অমিলকে মেলায় কার সাধ্য। শিয়ালদহ স্টেশন আর দমদম এয়ারপোর্ট, ফ্লাইওভারের ওপর আর নিচের জগতকে মিলিয়ে মিশিয়ে বুঝে নেওয়া কি যায়? তাই রোজকার জীবনের চলার পথে দ্বন্দ্বের ধন্ধে পড়ি এমন সম্ভাবনাকে এড়িয়ে চলি। যার যেখানে বর্তমান অস্তিত্ব তার পরিধির বাইরে পা ফেলি না সহসা। বর্তমানকেই আঁকড়ে ধরে তাকেই স্ফীত করে তুলি ক্রমাগত। আর চিন্তাভাবনার জগতে হয় এদিক নয় ওদিক—কোনও একটা পক্ষ নিয়ে ফেলে চটজলদি সমাধানে দ্বন্দ্বটাকেই এড়াই।
অর্থনৈতিক বিস্ফোরণ
আর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান, সমাজসংস্কৃতি, সমাজজীবন, ব্যক্তিজীবন, মানবিক সম্পর্ক — সর্বত্রই নানা ওলটপালট চলেছে। এ যেন এক নিয়ন্ত্রণহীন অন্তহীন প্রক্রিয়ায় সবকিছুই ভাঙছে, মোড় নিচ্ছে নানা দিকে যার কোনও ব্যাখ্যা মিলছে না। এ কি পরিবর্তন, নাকি ক্রমাগত ভেঙে চলার এক বিস্ফোরণ?
অবিশ্রান্ত ধারায় এই প্রক্রিয়া এসে পড়ে আচ্ছন্ন করছে আমাদের। কোথা থেকে এল, কোথায় গিয়ে থামবে এই স্রোত, আর কোথায় নিয়ে ফেলবে আমাদের? সবই কেবল ভেঙে চলেছে অতি দ্রুত। গড়ে উঠে স্থিতি পাচ্ছে না কোনও কিছুই। এক ভেঙে জন্ম হচ্ছে শত, শত ভেঙে হাজার, হাজার ভেঙে অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটি। সৃষ্টি হচ্ছে সীমার মাঝে অসীমের সন্ধানে অবিরাম রত এক বিস্ফোরিত সভ্যতার বিস্ফোরিত পৃথিবী।
বিস্ফোরণ কথাটা আজকাল সমাজতত্ত্বের গবেষকদের লেখাপত্রে বার বার উঠে আসছে। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আণবিক বিস্ফোরণ, আর পরবর্তীকালে অর্থনীতির আলোচনায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, এই দুটি মোটামুটি শোনা ছিল। আজকাল আরও নানান বিস্ফোরণের কথা উঠে আসছে—যেমন, তথ্য বিস্ফোরণ (information explosion), যোগাযোগ বিস্ফোরণ (communication explosion), শহরবাসী জনসংখ্যার বিস্ফোরণ (urban population explosion), পরিষেবা বিস্ফোরণ, পণ্য বিস্ফোরণ, আর্থিক লেনদেন বিস্ফোরণ, ঋণ বিস্ফোরণ (credit explosion), আর্থিক সম্পদ বিস্ফোরণ, শহরের জঞ্জাল বিস্ফোরণ (urban waste explosion), তথ্যপ্রযুক্তির জঞ্জাল বিস্ফোরণ (e-waste explosion), এমন সব কত কী। বিস্ফোরণের তো শেষ নেই। গত তিন দশকে এই বিস্ফোরণগুলো চমকপ্রদ চেহারা নিয়েছে।
পৃথিবীতে প্রথম সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে। তারপর থেকে তার সংখ্যা বেড়েছে ৫০ বছরে দশ গুণ, ১৫০ বছরে হাজার গুণ, আর ৩০০ বছরে লক্ষ গুণ। শুধুমাত্র বিজ্ঞান-বিষয়ক বই আর গবেষণাপত্রই এখন ছাপা হয় বছরে লক্ষাধিক। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে যোগাযোগ ও তথ্যবিস্ফোরণের চেহারা আরও ভয়ানক। বছরে ৩০ শতাংশেরও বেশি হারে নতুন নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষের মাথাপিছু তথ্যের পরিমাণ এখন বাড়ছে প্রতি বছরে ৮০০ মেগাবাইট করে। স্বভাবতই তথ্য মাপার পরিমাপকেও বাড়িয়ে চলতে হচ্ছে। বাইটকে একক ধরে কিছুকাল আগেও আমাদের ব্যবহারে লাগত কিলোবাইট (১০৩ বাইট), মেগাবাইটের (১০৬ বাইট) হিসাবে তথ্যের পরিমাপ। আজকাল ব্যবহারে এসে গেছে গিগাবাইট (১০৯ বাইট), টেট্রাবাইট (১০১২ বাইট), পেটাবাইট (১০১৫ বাইট), এক্সাবাইট (১০১৮ বাইট), জেট্টাবাইট (১০২১ বাইট)।
অন্যদিকে চোখ ফেরালেও একই ছবি। প্রতিনিয়ত ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, ইত্যাদি নানা ধরনের খেলা, সিনেমা ও টিভির সিরিয়াল সৃষ্টি ও তাই নিয়ে নানাবিধ বাণিজ্য চলেছে। আর্থিক লেনদেনের অকল্পনীয় বৃদ্ধি ঘটছে যার সাথে দেশের জাতীয় উৎপাদনের কোনই সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে না। এক কথায় মানুষের কর্মকাণ্ডের অন্তহীন প্রসার ঘটেই চলেছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অতি দ্রুত ও অন্তহীন প্রসার বর্তমান শহরসভ্যতার মূল চরিত্র। ক্রমাগত বিস্তৃতিই সৃষ্টি করছে আরও বিস্তৃতির প্রয়োজন। আজকের এই উন্নয়ন আসলে এই বিস্তৃতিরই এক প্রক্রিয়ামাত্র। প্রসারের মাধ্যম চাই, চাই বিস্তৃতির ক্ষেত্র। তাই উন্নয়নের ঢেউ এসে আছড়ে পরে উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে, শহর থেকে গ্রামে। আমরা সকলেই আজ এর অধীন। সব কেমন গুলিয়ে গিয়ে এই উন্নয়নই হয়ে উঠেছে একমাত্র সত্য।
আমরা কোথায় চলেছি, আর কোথায় যেতে চাই, কোন পথে, সেসব ভাবার আর অবকাশ নেই। সভ্যতার বর্তমান স্তরে, বিশেষত গত তিন দশক যাবত, এই অন্তহীন অর্থনৈতিক প্রসারের চরিত্র ক্রমশ বিকশিত হয়ে আজ হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। অথচ এটাই কিন্তু মানবসভ্যতার বিকাশের একমাত্র পথ ছিল না। মানবসভ্যতার বিগত দশ হাজার বছরের নথিভুক্ত ইতিহাসে এই অর্থনৈতিক প্রসারের কোনও প্রমাণ মেলে নি। এর জন্ম গত তিনশ বছরে শিল্পসভ্যতার বিকাশের স্তরে।
অন্তহীন প্রসার
অন্তহীন প্রসার সম্ভব কেবলমাত্র অনন্তে। কিন্তু আমাদের জগত যে স্থান ও কালের নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধা। প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারও নির্দিষ্ট। তাহলে অন্তহীন প্রসার, বছরের পর বছর কেবলই ইকনমিক গ্রোথ হয়ে চলা কীভাবে সম্ভব? যেকোনও নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ স্থানে ক্রমাগত প্রসারের চাপ সাধারণ নিয়মেই সৃষ্টি করে বিস্ফোরণ। গত তিন দশকে অর্থনৈতিক প্রসার রূপান্তরিত হয়েছে অর্থনৈতিক বিস্ফোরণে (economic explosion)। তারই প্রতিফলনে আজ দেখা মিলছে আরও কত বিস্ফোরণের।
অসীমের সন্ধানে অর্থনৈতিক প্রসার আমাদের কর্মকাণ্ডের পৃথিবী অসীম নয়। বস্তুগত নির্দিষ্ট সীমায় সে বাঁধা। এই সীমায় অর্থনৈতিক প্রসার অবরুদ্ধ। অথচ তার চাই ক্রমাগত প্রসার। না হলে সবটাই যে বিপরীত প্রক্রিয়ায় চুপ্সে যেতে থাকবে।
এই অর্থনৈতিক প্রসারের প্রয়োজনে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এক, বস্তুগত উৎপাদনে উপাদানের ব্যবহার যথাসাধ্য কমানো, যাতে একই পরিমান উপাদান থেকে আরও বেশী পণ্যবস্তু উৎপাদন সম্ভব হয়। ফলে ক্রমশ বাতিল হয়ে যায় পুরনো যুগের শিল্প, সংস্কৃতি, ও পছন্দ। আসে আধুনিক যুগের হাল্কা, ছিমছাম আর সীমিত আয়ুর পণ্যবস্তু উৎপাদন। দুই, আসে ক্রমাগত নতুন থেকে নতুনতর ভোগ্যবস্তুর উৎপাদন ও তার ব্যবহারে মানুষকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। এই কারণেই পালাবদল ঘটে বাজারব্যবস্থার ভূমিকার।
অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকের ব্যাখ্যায় বাজারের ভূমিকা বেশ নিরীহ — পণ্য কেনাবেচার ব্যবস্থা মাত্র। সেই নিরীহ ভূমিকা ছেড়ে বাজার চেপে বসে মানুষের ঘাড়ে। এক দিকে শেখাতে শুরু করে কী কী কিনতে হয়, সৃষ্টি হয় বিজ্ঞাপনের দুনিয়া। অন্যদিকে বলে দেয় কী কী বাজারে বিকোবে বলে কীভাবে কতটা উৎপাদন করতে হয়—গরীবমানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন হবে, নাকি উচ্চবিত্তের ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন হবে।
এই দুই পরিবর্তনের পথে ঘটল ভোগ্যবস্তুর বিস্ফোরণ। অবিশ্রান্ত ভোগ্যবস্তুর আক্রমণে অনেক মানুষই দিশেহারা। ভোগবাদের বিরুদ্ধে অনেক কথাই শোনা যায়। পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় নিয়েও কথা হয়ে থাকে। কিন্তু সেসব কথা চাপা পড়ে গেছে — কে থামাবে এই বিস্ফোরণ? বহুকাল আগেই এক বিখ্যাত মনীষী শহরের দোকানে সজ্জিত বস্তুসামগ্রী দেখে অবাক হয়েছিলেন — বেঁচে থাকার জন্য মানুষের এত জিনিস লাগে!
ভোগ্যবস্তু উৎপাদনে বিস্ফোরণ ঘটিয়েও কিন্তু অর্থনৈতিক প্রসারের মেলে না অসীমের সন্ধান। কারণ এ পথও অন্তহীন নয়। বস্তু উৎপাদনে উপাদানের ব্যবহার যতই কমানো হোক, তাকে একেবারে শূন্য করে ফেলা যায় না। অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা আছে এমন মানুষের সংখ্যা ও তাদের বস্তুগত ভোগক্ষমতারও সীমা আছে।
গত শতাব্দীর ১৯৭০-এর দশকে দেখা দিতে থাকে এ পথেও প্রসারের সঙ্কট। একে একে আসে অসীমের সন্ধানে আরও তিনটে পথ। প্রথমে আসে পরিষেবা ও মনোরঞ্জনের ভোগ্যপণ্যের বাজার বিস্তার — সার্ভিস সেক্টর (service sector) ও এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির (entertainment industry) অতি দ্রুত চমকপ্রদ বৃদ্ধি আরেক বিস্ফোরণের আকার নেয়। এইসব মানসিক ভোগের পণ্য উৎপাদন করতে তেমন কোনো বস্তুগত উপাদানের প্রয়োজন হয় না। তাই উপাদান-নির্দিষ্ট সীমাকে অতিক্রম করা যেতে পারে। কিন্তু এ পথেও অন্তহীন প্রসার সম্ভব হয় না, কারণ ক্রয়ক্ষমতা আছে এমন মানুষের সংখ্যা ও তাদের ভোগের স্পৃহার একটা সীমা তো থেকেই যায়।
১৯৮০-র দশক থেকে অসীম প্রসারের সন্ধানে আসে অন্য দুটি পথ — বিকাশ ও বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে তথ্যপ্রযুক্তির ও তার তথ্যপণ্যের (data commodity), এবং তারই সাহায্যে আর্থিক লেনদেনের আর্থিক পণ্যের (financial commodity)। এই দুটি পণ্যের বিশেষ চরিত্র লক্ষণীয়। এরা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করে, আর একে অপরকে ধরে বেড়ে চলে। একই তথ্য ভেঙে হাজার হাজার তথ্য সৃষ্টি হয়ে তথ্যের প্রয়োজনকে বাড়িয়ে নিয়ে চলে। একই ভাবে একটা আর্থিক পণ্যের লেনদেন সৃষ্টি করে আরেকটা আর্থিক পণ্যের লেনদেন ও প্রক্রিয়াটা ক্রমান্বয়ে চলতেই থাকে। এরা হল এক নতুন প্রজাতির আর্থিক পণ্য যার নাম ডেরিভেটিভ (derivatives)। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে গড়ে ওঠা বিশ্বব্যাপী এর বাজারে এক এক লহমায় লেনদেন ঘটে যার দৈনিক পরিমাণ মিলিয়ন বা বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ডলার অঙ্কে প্রকাশ করতে হয়।
অর্থনীতির তত্ত্ব ও ধারণাকে নাকচ করে বিস্ফোরণের আকারে বৃদ্ধি ঘটেই চলেছে। ১৯৭০-এর দশকে অর্থনীতিবিদেরা চমকিত হয়েছিলেন পরিষেবা শিল্পের বাড়বাড়ন্ত দেখে। উৎপাদনশীলতা যেখানে বেশী সেখানেই তো প্রসার হওয়ার কথা। কিন্তু সাধারণ শিল্পোৎপাদন থেকে পরিষেবা শিল্পে উৎপাদনশীলতা কম হতেই দেখা গেছে। তাই এর প্রসারকে অভিহিত করা হল ‘প্যারাডক্স অভ সার্ভিস সেক্টর গ্রোথ’ (paradox of service sector growth)। ১৯৮০-র দশকের শেষে এসে অর্থনীতিবিদেরা আবারও চমকিত হলেন — তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উৎপাদনশীলতা আদৌ বেশী নয়, আর এর ব্যবহারে সার্বিক উৎপাদনশীলতাও বাড়েনি। অতএব, এর নাম হল ‘প্যারাডক্স অভ প্রোডাক্টিভিটি’ (paradox of productivity)। আজকাল অর্থনৈতিক প্রসার (গ্রোথ) আর উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট) আলাদা করে দেখা হয় না। তাই উন্নয়ন-স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা তথ্যপ্রযুক্তি আর পরিকাঠামো ও পরিষেবা ক্ষেত্রের প্রসারকেই শিল্পায়ন ও উন্নয়ন বলে হাজির করেন। বলা হয় না, যাকে উন্নয়ন বলা হচ্ছে তা আসলে আর্থিক প্রসারের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করা। তাই বন্ধ কলকারখানার জমিতে গড়ে ওঠে পঞ্চাশ তলা, একশ তলা আবাসন প্রকল্প, শহর ছেয়ে যায় ফ্লাইওভার, মাল্টিপ্লেক্স, আর শপিং মলে। অন্যদিকে হাজারে হাজারে গ্রাম থেকে যায় দারিদ্র্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত।
অন্তহীন প্রসার যে সভ্যতার বর্তমান স্তরের এক বিশেষ অন্তর্নিহিত চরিত্র সে কথা বলা হয়েছিল বহুকাল আগেই কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বে। এই কথাটা অবশ্য এতকাল অর্থনীতির তত্ত্বকথার মূল স্রোত মানতে নারাজ ছিল — অর্থনৈতিক প্রসারকে ভাবা হত বাইরের কারণে ঘটা এক প্রক্রিয়া, এক্সোজেনাস্ গ্রোথ। অধুনা এই অন্তর্নিহিত প্রসারের চরিত্র স্বীকৃতি পেয়েছে, নাম হয়েছে এন্ডোজেনাস গ্রোথ (endogeneous growth), ও তার তত্ত্বতালাশ চলেছে নানাভাবে। যে কথাটা অনুল্লিখিত থেকে গেছে তা হল এর আসল নাম — ম্যালিগন্যান্ট ইকনমিক গ্রোথ ।
ভোগ্যবস্তুর বিস্ফোরণ, মানসিক ভোগ্যপণ্যের বিস্ফোরণ, ও অবশেষে তথ্যপণ্য আর আর্থিকপণ্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানবসভ্যতা আজ সীমার মাঝে অসীমকে সৃষ্টি করতে উদ্যত। প্রথম দুটো ক্ষেত্রে সীমার বাঁধনকে অতিক্রম করা যায়নি। কিন্তু পরের দুটো পথে অন্তহীন প্রসার যেন সম্ভব হয়ে উঠেছে। কারণ, এরা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টি করতে পারে ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে। হয়তোবা নিজেদেরকে ধারণও করতে পারে, বা নাও পারে। ভবিষ্যতই বলবে সে কথা। কিন্তু আমরা, মানুষেরা কি পারব এই বিস্ফোরণগুলোকে ধারণ করতে?
Reprinted: Parikatha, May 2006

ফিরে দেখা — অন্য অর্থনীতির সন্ধানে

তথ্যে ভারাক্রান্ত মানুষ
You May Also Like

ফিরে দেখা — অন্য অর্থনীতির সন্ধানে
January 12, 2022