Education

ফিরে দেখা — বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিশুশিক্ষা ভাবনার আঁতুড় ঘর

গ্রামের শিশুদের লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে বারংবার হোঁচট খাওয়ার শুরু সেই ২০১৪ সাল থেকে। বীরভূম জেলার বোলপুর-শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে উত্তরে গোয়ালপাড়ার পথের ডাইনে লাগোয়া সাঁওতাল অধুষ্যিত দুটি আদিবাসী গ্রাম — ফুলডাঙা আর কলাপুকুর ডাঙা। কোন্‌ সৌভাগ্যে জানিনা কলাপুকুর ডাঙার পূব প্রান্তে ও ফুলডাঙার উত্তর সীমানায় একটা বাসাবাড়ী হয়ে গেল ২০১০ সালের জুলাই মাসে। জায়গাটা তখনও বেশ খোলামেলাই ছিল। আশেপাশে বাড়িঘর তেমন ছিল না। পাশেই তালতোড় দীঘি। সে অবশ্য তৎকালীন সরকারের বদান্যতায় কোম্পানির দখলে গিয়ে হয়ে গেল সায়র বীথি এন্টারটেনমেন্ট পার্ক। স্থানীয় বাসিন্দাদের আর টিকিট না কেটে দীঘির কাছে যাওয়া তো দূরস্থান, হাঁটতে চলতে পথের ধারে ওকে চোখে দেখার সুযোগও রইল না।

চিড়িয়াখানার বাঘের মতো দীঘিও ঘেরা হল সরকারি উন্নয়ন তথা কোম্পানির দখলদারির বেড়াজালে। শীতকালে দেখেছিলাম অনেক পাখি আসত এই দীঘিতে। হয়ত টিকিট কাটার ভয়ে তারাও আর আসে না। তার ওপর বোট রাইডিং এন্টারটেনমেন্টের উৎপাত তো আছেই। যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর পেয়ে ২০১৩ সাল থেকে সুযোগ হল এই ফুলডাঙাতেই বেশি সময় থাকার । সে এক বিচিত্র জায়গা — না গ্রাম, না শহর। গ্রাম দুটোতে আছে আদি বাসিন্দা সাঁওতালদের বসতি। এছাড়া আছে, সম্ভবত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর নির্মাণকালে, বীরভূমের পশ্চিমে লাগোয়া বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) থেকে আগত পাহাড়িয়া উপজাতি ও অন্যান্য কিছু হিন্দী ভাষাভাষী মানুষ। সম্প্রতি আশেপাশের জেলাগুলো থেকেও অনেকে নানান কাজেকর্মে এসে বসবাস করছেন এই এলাকায়।

শান্তিনিকেতন আজ এক বিশেষ ভ্রমণ কেন্দ্র। অগুনতি হোটেল, লজ, গেস্টহাউস, রেস্তোরা, আর আজকালকার ফ্যাশন ওই হোম-স্টে, ইত্যাদি তো আছেই। অবস্থাপন্ন অনেকেই শান্তিনিকেতনের আশেপাশে বড় বড় বাড়িঘর গড়েছেন হাওয়া বদলের সাময়িকবাস হিসাবে। এঁরা বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজনদের নিয়ে উৎসব, মেলা, পালা-পার্বণে আসেন-যান বটে, তবে থাকেন না বিশেষ। স্থানীয় মানুষদের কথায় এঁরা হলেন ‘কলকাতার বাবু’। কেউ আবার বেড়াতে আসা বাবুদের নাম দিয়েছে ‘বোটু’, মানে, বোকা টুরিস্ট। বড় বড় আবাসনে ফ্ল্যাটবাড়িও তৈরি হয়েছে অনেক। সেসবও খালি পড়ে থাকে অধিকাংশ সময়। এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষের বড় অংশের উপজীবিকা হয় দাঁড়িয়েছে এসবের নির্মাণকর্ম, মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণ (কেয়ারটেকার), রাত পাহারা (নাইট গার্ড), প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিসিয়ান আর বাগানের মালি, হোটেল রেস্তোরা ও বাড়ির পরিচারক বা পরিচারিকার কাজ। এছাড়া রিক্সা, অটো, টোটো চালানো, ছোটখাট দোকানদারী বা চায়ের দোকান দেওয়াও আছে।

গ্রামের কোনও কোনও ছেলেরা যায় অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে ভিন্‌ রাজ্যে। সাঁওতাল মেয়েদের কেউ কেউ পাড়ি দেয় গৃহ-পরিচারিকার কাজে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, ইত্যাদি শহরে। আরও একটা আছে—মাথায় ফুল গুঁজে সেজেগুঁজে বিকেলে সোনাঝুরির হাটে সাঁওতালি নাচ নেচে ‘বোটু’-দের মনোরঞ্জন করে কিছু টাকা রোজগার। ভ্রমণ কেন্দ্রের পাশাপাশি শান্তিনিকেতন আবার বীরভূম ও বর্ধমান জেলার নিকটবর্তী অঞ্চলের স্কুলশিক্ষার কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে। একাধিক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম ও কিছু বাংলা মাধ্যম ইস্কুল গজিয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক কালে। এগুলোতে পড়তে আসে বোলপুর ও তার আশেপাশের এলাকা ছাড়াও রেল বা বাস যোগাযোগ আছে এমন এলাকার একটু অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা ।

আরও দূর থেকে আগতদের জন্য কিছু ছাত্রাবাসও নজরে পড়ে। বড়সড় কয়েকটা আবাসিক ইস্কুলও হয়েছে। আর নজরে পড়ে বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থার নানা রকম শিক্ষা উদ্যোগ। রথ দেখা ও কলা বেচার মতো ভ্রমণ আর সমাজসেবার জন্য শান্তিনিকেতনের আশপাশের গ্রামীণ এলাকাগুলো বেশ আকর্ষণীয়। তাই সমাজসেবা-সফরকারীদের এখানে নিত্য আনাগোনা। এই সুবাদে বিদেশ থেকে সাহেবসুবোদেরও আসাযাওয়া ঘটে। ফলে দেখা যায়, গ্রামগুলো রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কোনও না কোনও সমাজসেবী সংস্থা ও সমাজসেবা-সফরকারীদের থেকে নানাবিধ দানে — যেমন, জামাজুতো, খেলনা, বই, খাতা, পেনসিল, ব্যাগ, টিফিন বাক্স, জলের বোতল, এমনকি চিপ্‌স বিস্কুট কেক্‌ কোল্ড ড্রিংক্স, ইত্যাদি। এই সমাজসেবা-সফরকারী আর ‘বোটু’-দের জন্য শান্তিনিকেতনের উত্তরে শ্যামবাটি পার করেই বাঁহাতে সেচখালের পাড় বরাবর সোনাঝুরিতে বিকেলবেলায় আদিবাসী নাচের আয়োজন ও ‘এথনিক’ হাতের কাজ নিয়ে মেলা বসে ‘আমাদের হাট’, ‘শনিবারের হাট’ ইত্যাদি নামে।

বিকেল হলেই ওই রাস্তা গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। যাওয়া আসাই দুষ্কর। ওখানে লাল মাটির রাস্তা আর নেই, পিচ ঢালাই হয়ে গেছে, দুপাশের সোনাঝুরি গাছগুলো কেটে রাস্তা চওড়া হয়েছে, উন্নয়নের স্রোতে সেচ খালের আগাপাশতলা কংক্রিট ঢালাই হয়ে গেছে। যদিও এই এলাকা এখনও রূপপুর পঞ্চায়েতের আওতায়, শোনা যাচ্ছে শীঘ্রই তা বোলপুর মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভুক্ত হবে। গ্রামের এলাকায় কৃষিকাজের জমিই আর তেমন নেই। আদি বাসিন্দা সাঁওতালদের কারো কারো একটু দূরের এলাকায় অল্প কিছু দু-চার বিঘা চাষের জমি আছে, যেখান থেকে পারিবারিক শ্রমে বছরের ধানটুকু হয়ত হয়। শহরের প্রভাবে আচ্ছন্ন গ্রাম দুটিতে নিজস্ব গ্রামীণ জীবনসংস্কৃতির বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই, জন্মমৃত্যু বিয়ে-শাদি আর দুয়েকটা সাঁওতালি পরবের অনুষ্ঠানাদি ছাড়া। স্থানীয় সাঁওতাল আদিবাসীরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা স্বভাবতই সাঁওতালী ভাষাতেই বলে। কিন্তু দোকানবাজারে বা বাঙালি বাবুর বাড়িতে কাজকর্মের প্রয়োজনে তারা, স্বচ্ছন্দ নাহলেও, বাংলাতেও কথা বলা রপ্ত করে নিয়েছে। এছাড়া খানিকটা হিন্দি ভাষা আর কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহারও ঢুকে পড়েছে টিভি, হিন্দি সিনেমা ও হিন্দি গান, ডিজে মিউজিক, মোবাইল ও স্মার্টফোন ইত্যাদির হাত ধরে।

এমনই এক বিচিত্র জায়গায় অবসর জীবনের শুরু ২০১৩ সালে। সকাল ১০টা নাগাদ দেখতাম ইস্কুলের জামা-জুতো পরে একটু বড়, প্রাথমিক স্তর পার করা, ফুলডাঙার ছেলেমেয়েরা সাইকেল করে ইস্কুলে যাচ্ছে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়ায় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরা ফেরে বিকেল ৪টে নাগাদ। এদের অধিকাংশই আবার ‘প্রাইভেট টিউশন’ নিতে যায় আরও সকালে, ইস্কুলে যাওয়ার আগে, ও পড়ন্ত বিকেলে, ইস্কুল থেকে ফিরে এসে। এদের বাবা-মায়ের মোটামুটি একটা স্থির রোজগার আছে। অনেকেই বাবুদের বাড়ির কেয়ারটেকার, তার ওপর বাগানেরও মালি। সেখানেই তারা বসবাস করে। পাশাপাশি বাবা হয়ত অটো বা টোটো চালায়, মা অন্যত্র পরিচারিকার কাজ করে সুবিধামতো।

আরেক দল বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখতাম সকাল দুপুর টইটই করে বেড়াতে — গরমের দুপুরে হাতে গুলতি, কোথায় কোন্‌ গাছে কী ফল ধরেছে তার সন্ধান, তা সে যতই টক বা কষা হোক না কেন, বর্ষায় সেচ খাল আর নালাগুলো ভরে মাঠঘাট ভাসিয়ে দিলে সারাদিন সকলে মিলে ভেসে আসা চুনো মাছ ধরা। এদের অধিকাংশই গ্রামের আদিবাসী ঘরের, বয়েস মোটামুটি ৫-৬ থেকে ৮-১০ বছর। জামাকাপড়েরই ঠিকঠিকানা নেই, পায়ে চটি বা জুতো তো ভাবাই যায় না। এরা প্রাথমিক ইস্কুলে যায় কিনা, লেখাপড়া আদৌ করে কিনা সন্দেহ। অবশ্য প্রায় ছয় দশক ফিরে দেখে তেমন অবাক হই না — আমিও তো এমনই ছিলাম। ইস্কুলের গণ্ডীতে প্রবেশ একবারে তৃতীয় শ্রেণিতে, চতুর্থ শ্রেণিতে স্থান না পেয়ে। ইস্কুল আর লেখাপড়া ব্যাপারটা যে ঠিক কী তা বুঝে ওঠার আগেই কেমন করে জানি বছর বছর টায়টুয়ে পাশ করে ইস্কুলের গণ্ডী পার হয়ে গেলাম। প্রথম দু-তিন বছর তো চলে গিয়েছিল পরীক্ষা আর পাশ-ফেল ব্যাপারটাই বুঝতে।

ইস্কুলে লেখাপড়া কী শিখেছি কিছুই মনে পড়ে না। বাড়িতে দিদি-দাদা ছিল। বোধহয় তাঁদের লেখাপড়ার স্রোতেই আমার হাতেখড়ি থেকে ইস্কুলের লেখাপড়া যা কিছু শেখা। বাকিটা বয়েসকালে নিজের দরকারে বাধ্য হয়ে যেটুকু পারা যায় নিজে শেখা। কিন্তু ফিরে দেখলেই তো হয় না—‘ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি’। বড় জোর আক্ষেপ করা যায় — ‘মা কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন’। ছয় দশকে পৃথিবীটা অনেকটাই বদলে গেছে। শিশুশিক্ষার এখন অনেক আয়োজন। ‘জাতীয় সাক্ষরতা’ মিশন পার করে হাঁকডাক করে চলেছে সর্বসাধারণের শিক্ষার জন্য ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’। আয়োজনের সাথে সাথে এসেছে নতুন নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি, ন্যূনতম যোগ্যতাসহ প্রশিক্ষিত শিক্ষকশিক্ষিকা, নানান নিয়মনীতি, আর বেড়েছে রঙবেরঙের মোটামোটা পাঠ্যপুস্তকের বোঝা। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকেই ইস্কুল শিক্ষাতেও এডুকেশন কোম্পানির অনুপ্রবেশে তালগোলটা পাকিয়েছে আরও। কারণ এদের নজর শহরের বিত্তবান ঘরের শিশুরা। শিক্ষা ব্যাপারটার অভিমুখ, আগেও অবশ্য তাই-ই ছিল, এখন আরও বেশি করে হয়ে উঠেছে শহুরে। আজকাল শহরে প্রায় পাঁচতারা হোটেল ঢঙের ইস্কুলে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে।

পাঠ্যপুস্তকগুলোও লেখা হয় শহরের শিশুদের কথা ভেবে। তা নয়ত ‘সর্বসাধারণের’ শিক্ষার জন্য লেখা পাঠ্যপুস্তকে “ফুটপাথ”, “জেব্রা ক্রসিং”, “ট্রাফিক লাইট” ইত্যাদি শহুরে বিষয়ের আধিক্য কেন? গ্রামের শিশুরা এগুলো বুঝবে কী করে? শিশুশিক্ষার আয়োজনে আজকাল শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে, নানান প্রক্রিয়ায় নানান শিক্ষা উপকরণ বা টিচিং এড, ওয়ার্কশীট ইত্যাদি ব্যবহার করতে লাগে। কোথাও ব্যবহার হয় অ্যাবাকাস, কোথাওবা ব্যবহার হয় জোড়-জ্ঞান। এসবই শহরের শিশুদের বড় বড় ইস্কুলের বড় বড় ব্যাপার। কিছু কিছু সমাজসেবী সংস্থা অবশ্য চেষ্টা করেন এগুলিই ব্যবহার করে গ্রামের শিশুদেরও শেখাতে। কতটা সফল হয় জানি না। গ্রামে গ্রামে ইস্কুলের সরকারি আয়োজনও কম হয়নি। ‘রাইট টু এডুকেশন’ আইনে গ্রামের এক কিলোমিটারে প্রাথমিক ইস্কুল, মিড-ডে মিল, ইস্কুলের জন্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের পাঠ্যপুস্তক নির্মাণ (বিশাল বইগুলি দেখলে বোঝা যায়, ওগুলি লেখা নয়, নির্মাণই বটে) ও বিনামূল্যে বিতরণ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকশিক্ষিকা নিয়োগ, ইত্যাদি হয়েছে অনেক কিছুই।

কিন্তু গ্রামের, বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী শিশুদের কাছে কি পৌঁছনো গেছে? এই ফুলডাঙারই মাঠেঘাটে ভরদুপুরে টইটই করে বেড়ানো বাচ্চাগুলোকে দেখে তো তা মনে হয় না। ওদের দেখে অবাক হইনা, কারণ ছয় দশক আগের ছেলেবেলাকে দেখতে পাই। কিন্তু ভয় পাই আজকের এই পৃথিবীতে ওদেরকে দেখে। শিশুদের লেখাপড়াও যে আজ এক প্রতিযোগিতা। রেল লাইনের রেলগাড়ির মতোই তাকে চলতে হয়। লেট ট্রেন যেমন ক্রমাগত লেট করতেই থাকে, ইস্কুলের লেখাপড়াতেও একবার পিছিয়ে পড়লে কেবল পিছিয়েই পড়তে হয়, আর তাল মেলানো যায় না। সেই আমিই কি পারতাম এই পৃথিবীতে, নাকি ওরা পারবে লেখাপড়া শিখে নিতে? ফুলডাঙাতেই একটা অঙ্গনঅয়াড়ি কেন্দ্র (ICDS) আছে গ্রামের কচিকাঁচা (৬ বছর বয়েসের নিচে) ও মায়েদের জন্য। চলে মোটামুটি সকাল ৮টা থেকে ১০টা। সেখানে মূলত বাচ্চা ও মায়েদের খাওয়া জোটে। তার ব্যবস্থা করতেই সময় চলে যায়। বাচ্চাদের প্রাক্‌-প্রাথমিকের পড়াশোনাও একটু আধটু করার কথা বটে, কিন্তু সে বিশেষ হয়না।

এদিকে আরেক মুশকিল হল অনেক মায়েদের আবার কাজে যেতে হয় সকাল সকাল। বাচ্চাকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আনা-নেওয়া এদের একটা সমস্যা হয়। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ছাড়াও ফুলডাঙায় স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার জন্য আছে সরকারি প্রকল্পের আশা দিদিমণিরা (Accredited Social Health Activist or ASHA)। সর্বশিক্ষা অভিযানের প্রাথমিক ইস্কুলও একটা আছে। বোলপুর-শান্তিনিকেতনের লাগোয়া বলেই হয়ত ফুলডাঙা গ্রামে বর্ষিত হয়েছে বহুবিধ সরকারি প্রকল্পের সুবিধা, যা কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে তেমন নজরে পড়ে না। প্রত্যন্ত গ্রামে তো আর এমন সুযোগ হয় না — শহরে থেকেই গ্রামসেবা করার। ফুলডাঙার প্রাইমারি বা প্রাথমিক ইস্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি চলে সকাল ১০.৩০টা থেকে ১টা। মিড-ডে মিল খাওয়ার পর এদের ছুটি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পড়া চলার কথা আরও এক ঘন্টা, মানে বেলা ২টা পর্যন্ত (পশ্চিমবঙ্গে সরকারি নিয়মে এখনও পঞ্চম শ্রেণিকে প্রাথমিকের আওতায় আনা হয় নি)।

এতসব আয়োজন সত্ত্বেও এই ফুলডাঙাতেই সারাদিন মাঠেঘাটে টইটই করে বেড়ানো ছেলেমেয়েগুলোর লেখাপড়া নিয়ে খোঁজ করে বুঝলাম কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়ে আছে। মাঠেঘাটে টইটই করা তো থাকবেই, কিন্তু তার সাথে এদের কাছে লেখাপড়াটা কি কোনওভাবে একটু আকর্ষণীয় করে দেওয়া যায় না? একটু বুঝিয়ে দিলে, ধরিয়ে দিলেই হয়ত এদের অনীহাটা কাটে। যেকোনও কারণেই হোক, ইস্কুলে হয়তো তা হয় না। এদিকে এরা অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের বিদ্যার্থী, বাড়িতে এমন কেউ নেই যে একটু দেখিয়ে দিতে পারে। আমি নাহয় বাড়িতে দিদি-দাদা ছিল তাই উৎরে গেছি। এদের কী হবে? ওদের জন্য এটুকু ব্যবস্থা কি করতে পারি না — বিকেলে ঘণ্টা দুয়েক সময়— সকলে মিলে একটু খেলাধুলা, একটু কিছু টিফিন খাওয়া, আর তার সাথে কেউ একটু হাতে ধরে লেখাপড়াটাও শিখিয়ে বুঝিয়ে দেয়?

এই ভাবনা থেকেই শুরু হল পথ চলা। বাড়ির লাগোয়া এক চিলতে জমি। সেখানে একটা ছোটখাট ঘর তুলে বাচ্চাগুলোর পড়তে বসার ব্যবস্থা করাই যায়। হিসেব করে দেখলাম মাসান্তে পেনশন যা পাই তাতে মোটের ওপর ভালভাবেই চলে যায়। তারপরেও বেশ কিছু টাকা বেঁচে যায়। বৎসরান্তে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কদিনের বিদেশ দেখার বাতিক আমার নেই। তাই ওই টাকা থেকেই একজন আদিবাসী দিদিমণির জন্য কিছু সাম্মানিক, বাচ্চাদের একটু টিফিন আর বই খাতা পেনসিল, খেলার সরঞ্জাম ইত্যাদি আনুষঙ্গিকের ব্যবস্থা তো করাই যায়। খোঁজখবর করে একজনকে পাওয়া গেল, আশা মূর্মু, উচ্চমাধ্যমিক পাশ। বাজারে মেলে এমনসব শিশুশিক্ষার বই, খাতা স্লেট পেনসিল ইত্যাদি জিনিসপত্র জোগাড় করে শুরু হয়ে গেল ১৪ই এপ্রিল ২০১৪, বাংলা নববর্ষের দিনে — লেখাপড়া, খেলাধুলো, আর টিফিন খাওয়া, সব মিলে বিকেলে ২ ঘণ্টা। সপ্তাহে একদিন বাদ। ১০ জন ১৫ জন করে দু-তিন মাসেই দেখা গেল প্রায় ৪০টি ছেলেমেয়ে জুটে গেছে। ৩-৪ বছর বয়েস থেকে ৯-১০ বছরের ছেলেমেয়েরাও আছে। এত ছেলেমেয়ে বলে আরও একজন দিদিমণিকে আনা গেল — লক্ষ্মী হেমব্রম (সোরেন)।

বিকেল হলেই সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার — পড়া শেষে এক টুক্‌রো ছোট মাঠে বাচ্চাগুলোর দৌড়োদৌড়ি খেলা, তারপর লাইন দিয়ে বসে টিফিন নেওয়া, তার একপাশে জনাকয়েক মায়েরা বসা। টিফিনের শেষে বাচ্চাদের দল নিয়ে মায়েদের ঘরে ফেরা। ছবিটা ভারি সুন্দর — বৎসরান্তে পূজোর সময় বাচ্চাদের জন্য কিছু জামাকাপড়, শীতের সময় একদিন চড়ুইভাতি আর সেদিন বাচ্চাগুলোর করা নানা অনুষ্ঠান — বেশ একটা সমাজসেবার আত্মপ্রসাদ।

কিন্তু আসলে এবার হোঁচট খাওয়ার শুরু—এটাই কী লক্ষ্য? বাচ্চাগুলোকে লেখাপড়াটা কীভাবে কী শেখানো হবে, কাকে কী শেখাতে হবে—তার কতটা কী হল? নানান উপলক্ষ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে অনেক কিছুই হচ্ছে, কিন্তু লক্ষ্যের দিকে কি আদৌ এগোলাম? শিশুশিক্ষার ঢাউস ঢাউস বইগুলো যা বাজারে মেলে বা সরকার ছেপে বিতরণ করেন সেসব তো একে শহুরে তায় ভয়ানক। আমিই নাড়াচড়া করে আঁতকে উঠি তো মাধ্যমিক পাশ দিদিমণিরা এগুলো দিয়ে বাচ্চাদের কী শেখাবে? বাচ্চারাই বা বইগুলো থেকে নিজেরা কতটা কী পড়ে শিখবে? তার ওপর বইগুলো সবই তো বাংলায় (ইংরেজি শেখারটা ইংরেজিতে) লেখা। তাহলে সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কী হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© Sutanu Bhattacharya