ফিরে দেখা — অন্য অর্থনীতির সন্ধানে

পথ চলতে চলতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ানো — সামনে কী আছে ভাবা ও ফিরে দেখা, এ পথে কেন এলাম, অন্য পথ কি আর নেই। করোনা বা কোভিড-১৯ অতিমারীর এই ২০২০ সালটা যেন এমনই। এই অতিমারী বিদ্যুৎ গতিতে সারা বিশ্বের শহরগুলোতে ছড়িয়েছে আর একে প্রতিরোধ করতে দেশে দেশে দীর্ঘকাল যাবতীয় কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা বা লকডাউনের ফলে হোঁচট খেয়েছে জাতীয় আর্থব্যবস্থা।
এতকালের মন্ত্র, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা “গ্রোথ” কোথায়, এখন তো চলছে সংকোচন! সারা বিশ্বে কৃষি ছাড়া সবক্ষেত্রেই উৎপাদন কমেছে, আয় কমেছে, রুটিরুজি হারিয়েছেন শহরাঞ্চলের জীবিকা-নির্ভর অসংখ্য মানুষ। সমস্যা শুধু দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের নয়, অকূল পাথারে পড়েছেন মাস-আনি-মাস-খাই মানুষেরাই আরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ অবস্থাই আপাতত চলবে। আগামী দু-এক বছরে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কোনও সম্ভাবনা নেই।
অর্থনৈতিক সংকোচন একবার শুরু হলে আর্থিক ঘূর্ণাবর্তে আরও সংকোচন আসে। এদিকে করোনা অতিমারী রোধেরও কোনও পথ পাওয়া যায়নি। এ রোগের চিকিৎসা কী আজও জানা যায়নি, প্রতিষেধকও (ভ্যাকসিন) পাওয়া যায়নি। আর সে পেলেই বা কী। আগামী দিনে “করোনা” যে রূপ বদল করে “মরোনা” হয়ে দেখা দেবেনা তার কী নিশ্চয়তা আছে? এই পথে এতকালের মানবসভ্যতাটাই কি তাহলে ধ্বংসের দিকে? এসব প্রশ্ন এসেই পড়ে। তাই অন্য অর্থনীতির সন্ধানে ফিরে দেখতে হয় — বেঁচে থাকার আর অন্য কোনও পথ কি নেই?
ফিরে দেখা—কেন্দ্রিকরণের অর্থনীতি
সময়টা ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ধরলে মোটামুটি চারশ বছর। এই চারশ বছরে গড়ে উঠেছে আমাদের আজকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সারা পৃথিবী জুড়ে এর একটাই রূপ আর তার পেছনে একটাই প্রক্রিয়া — কেন্দ্রিকরণ (centralisation)। শুরুটা হয়েছিল ইউরোপে পুঁজির কেন্দ্রিকরণ (centralisation of capital) দিয়ে — অনেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে টেনে নিয়ে মূলধন বা পুঁজিতে রূপান্তরিত করে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (joint stock compnay) বড় হওয়া আর সে যুগের রাষ্ট্র বা দেশিয় রাজতন্ত্রের সহায়তায় ঔপনিবেশিক ব্যবসা বাণিজ্যে (colonial trade) ফুলেফেঁপে ওঠা, যেমন বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এমনটাই দেখা গিয়েছিল মূলত ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলবর্তী ও সমুদ্র অভিযানে পারদর্শী স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বৃটেন, ও হল্যান্ড (আজকের নেদারল্যান্ডস), এই পাঁচটা দেশে। পঞ্চদশ শতাব্দীর (১৪০০—) শেষভাগ থেকে একের পর এক সমুদ্র অভিযানে (european explorations) নতুন নতুন উপনিবেশ স্থাপন ও সমুদ্র পথে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের এরাই ছিল পথিকৃৎ। এই পথে হঠাৎ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক অসীম সুযোগ এসে পড়লেও সে যুগে দরিদ্র এই দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের কারোই নিজের এত পুঁজি ছিল না যে একক বা যৌথ উদ্যোগে এই সুযোগ নিতে পারে। ফলে এল অন্য অনেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কেও পুঁজিতে কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থা — মূ্লধনের অংশীদারিত্ব হিসাবে শেয়ার, শেয়ার কেনাবেচা ও শেয়ারের দাম নিয়ে ফাটকা খেলার শেয়ারবাজার (স্টক এক্সচেঞ্জ), ও মুনাফার লভ্যাংশ হিসাবে শেয়ার প্রতি ডিভিডেন্ড দেওয়া।
সমুদ্র অভিযানে খুঁজে খুঁজে সম্পদ-সমৃদ্ধ দেশে উপনিবেশ স্থাপনের আগ্রাসী বাসনা আর সেই কাজে অনেকের সঞ্চয় নিয়ে বৃহৎ পুঁজির কোম্পানি গঠন করা — ইউরোপের ওই পাঁচটি দেশে দারিদ্র থেকেই জন্ম নিল সমৃদ্ধি সন্ধানের এই আগ্রাসী পথ, সুচনা হল ইতিহাসের এক বিশেষ যুগের। সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে এক একটা যুগের উদ্ভবের পেছনে মূল ভূমিকায় দেখা যায় ঘটনাচক্রে কোনও বিশেষ ঘটনা বা অবস্থার সৃষ্টি (চান্স ফ্যাক্টর) ও সেই থেকে তৈরি হওয়া সুদূরপ্রসারী প্রয়োজনসমূহ (নেসেসিটি ফ্যাক্টর) (Jacques Monod, Chance and Necessity)।
ইউরোপের এই বিশেষ যুগের সূচনায় চান্স ফ্যাক্টর হল ১৪৫৩ সালে ওসমানী তুর্কী (অটোমান টুর্ক) আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যে কনস্টান্টিনপল শহরের পতন (fall of constantinople) ও প্রাচ্য থেকে পণ্য আমদানির রেশম পথ (silk route) অবরুদ্ধ হওয়া। এর ফলে শুকিয়ে যেতে থাকে ইতালির বাণিজ্য নগরীগুলো, যার মারফৎ আমদানি হতো প্রাচ্যের উৎকৃষ্ট পণ্য ও যা নিয়ে ইউরোপের ব্যবসাবাণিজ্য ও রাজতন্ত্রের ভোগবিলাস চলত, কারণ সেই যুগে দরিদ্র ইউরোপের নিজস্ব কোনও উৎকৃষ্ট পণ্য বা ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য উদ্বৃত্ত উৎপাদন তেমন কিছুই প্রায় ছিল না। স্বভাবতই ইউরোপের ব্যবসায়ীকুল ও রাজা-রাজড়াদের প্রয়োজন হয়ে উঠল (নেসেসিটি ফ্যাক্টর) প্রাচ্য থেকে পণ্য নিয়ে আসার অন্য কোনও পথ খুঁজে বের করা (European economic motivation)। এর সাথে যুক্ত হল আরেকটা চান্স ফ্যাক্টর।
অতীতে (৮০০-১১০০) বারে বারেই ইউরোপের উত্তর থেকে এসে সমুদ্র অভিযানে পারদর্শী নর্সম্যানরা (norsemen) লুঠতরাজ চালাত ইউরোপের পশ্চিম উপকূলে। জলদস্যুতা বা ভাইকিং (vikings) ছিল এদের মূল কাজ। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এরা পশ্চিম উপকূলের দেশগুলোতে থিতু হয়ে বসবাস শুরু করে। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই ইউরোপের পশ্চিম উপকূলের ওই পাঁচটা দেশের সমুদ্রপথে আগ্রাসনের বিশেষ পারদর্শীতা ছিল। রাজতন্ত্রের ভোগবিলাস, ভাইকিংদের সমুদ্র অভিযান ও লুঠতরাজ, আর ব্যবসায়ীদের পুঁজি বিনিয়োগে মুনাফার বাসনা, এই ত্র্যহস্পর্শে ঘটল ইউরোপীয় কোম্পানি যুগের কেন্দ্রিকরণের সূচনা (european companies)।
মোটামুটিভাবে ষোড়শ (১৫০০) থেকে অষ্টাদশ (১৭০০) শতাব্দী হল স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বৃটেন, ও হল্যান্ড, এই পাঁচটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ (গোল্ডেন এজ), যদিও তা কালিমালিপ্ত উপনিবেশগুলোতে (সুসভ্য?) ইউরোপীয়দের অকল্পনীয় বর্বরতা, অকথ্য অত্যাচার, শোষণের ইতিহাসে (the golden age of piracy)। আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় মধ্যে কোম্পানিগুলোর মূল ব্যবসা চলত ঔপনিবেশিক বাণিজ্য ত্রিভুজে (triangular trade) দাস চালান, দাস কেনাবেচা, আর দাস নিয়োগ করে উৎপাদিত কৃষিপণ্য আর শিল্পজাত পণ্যের কেনাবেচা নিয়ে। কোম্পানির ব্যবসা বিস্তারে স্বভাবতই এল পণ্য উৎপাদন ও কেনাবেচার বাজারের কেন্দ্রিকরণ।
ঔপনিবেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের এই পরিকাঠামোকে ভিত্তি করেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, ১৮৩০ নাগাদ, ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব (industrial revolution) জন্ম দিল কোম্পানির মালিকানায় বাজারের জন্য শিল্পপণ্য উৎপাদনের আধুনিক কলকারখানা (মডার্ণ ইন্ডাস্ট্রি)। পুঁজির কেন্দ্রিকরণ থেকেই সৃষ্টি হল যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রিকরণ। উপনিবেশগুলোতে স্থানীয় আর্থব্যবস্থার পণ্য উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে গড়ে উঠল কোম্পানির উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা।
কেন্দ্রিকরণের পথ চলায় এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ একে একে এসে পড়ল লিমিটেড লায়াবিলিটির (limited liability act 1855) কর্পোরেট ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যের পণ্য পরিবহণে রেলওয়ে ব্যবস্থা (railway mania), বিস্তৃত শৃঙ্খলে বাঁধা কেন্দ্রীভূত বাজারব্যবস্থার শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার আধুনিকতা, আর সর্বোপরি গড়ে উঠল সবকিছুর দেখভালের জন্য এক একটা দেশ জুড়ে একই আইনকানুন জারি রাখার সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যার ইউরোপীয় নাম হল ‘নেশন স্টেট’ (spring of nations)। সবই যেন একই সূত্রে গাঁথা — কেন্দ্রিকরণ।
এরপরের দেড়শ বছরে আরও কেন্দ্রিকরণের পথে বিশ্ব জুড়ে এই ব্যবস্থারই বিস্তার ঘটল, দেশে দেশে মূল মন্ত্র হিসাবে স্থাপিত হল শহরসভ্যতার শিল্পায়ন-উন্নয়নের পথে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যের বাজারের ক্রমাগত বিস্তৃতি ঘটিয়ে রাষ্ট্রের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করে চলা (mercantalism and industrial growth)। এই মন্ত্রকেই তত্ত্বায়নে স্থাপনা দিতে জন্ম আধুনিক অর্থশাস্ত্রের (modern economics)। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে স্মিথ, ম্যালথাস, রিকার্ডো, মার্ক্সের ধ্রুপদী (classical economics) ধারার তত্ত্বালোচনার পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে এল মার্শাল, মেঞ্জার, জিভন্স, ওয়ালরাস ইত্যাদির নব্য ধ্রুপদী ধারা (neoclassical economics), ও তারপর ১৯৩০ দশকের অর্থনৈতিক সঙ্কটে কেইনসের তত্ত্বালোচনা থেকে জন্ম হল কেইনসীয় ধারা (Keynesian economics)। সকলেরই মূল ভাবনাধারা একই— “গ্রোথ” (economic growth), বা শহরসভ্যতার শিল্পায়ন-উন্নয়নে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্রমাগত বিস্তৃতি ঘটিয়ে রাষ্ট্রের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করে চলা।
অথচ এর বিপরীতে সুগঠিত গবেষণায় অন্য অর্থনৈতিক ভাবনা যে ছিল না তা নয়। কিন্তু তা হারিয়ে গেল আধুনিক অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বালোচনার স্রোতে। এই অন্য ভাবনা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ফরাসী অর্থনীতিবিদদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখায়, যার দেখা মেলে সেযুগের অর্থনীতি গবেষণার বিভিন্ন পত্রিকায়। দুর্ভাগ্য হল, ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার ও কলকারখানা ঘিরে আধুনিক শিল্পসভ্যতার (modern industrial society) বিকাশের চমৎকারিত্বে আচ্ছন্ন পরবর্তীকালের ইউরোপীয় অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় একে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হল না। উল্টে এই ফরাসী অর্থনীতিবিদদের আর অর্থনীতিবিদ নয়, অভিহিত করা হল ফিজিওক্র্যাট (physiocrats) নামে, যাঁরা অর্থনীতি নয়, প্রকৃতির নিয়মনীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন। ফলে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ভাবনাধারার ইতিহাসের আলোচনায় এই অন্য অর্থনীতির উল্লেখই মেলে না, বড়জোর ফিজিওক্র্যাট সম্বন্ধে একটা পাদটীকা ছাড়া। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির পরের দেড়শ বছরে ক্রমাগত কেন্দ্রিকরণে শহরসভ্যতা কেবলই বেড়ে উঠেছে (urban population explosion)। মূলত বাজার ব্যবস্থার পণ্য কেনাবেচা, পণ্য পরিবহন, ও আর্থিক লেনদেন আর তার প্রয়োজনে ক্রমাগত নগর নির্মাণ ও পরিষেবা বৃদ্ধি, এই হল শহরের কর্মকাণ্ড। নির্মাণ ও পরিষেবা শিল্প ছাড়া প্রকৃত অর্থে শহর তেমন কিছুই উৎপাদন করে না, শুধু কেনাবেচা করে। অথচ মানুষের ভিড়ে আর অর্থের স্রোতে ফুলেফেঁপে ওঠা এই শহুরে কর্মকাণ্ডেই জীবিকার দায়ে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ (৫০ শতাংশের বেশি) আজ শহরবাসী, যা হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি।
শহরবাসীর খাদ্যের যোগান স্বভাবতই আসে গ্রামাঞ্চল বা কৃষিক্ষেত্র থেকে। অতএব, অর্থনৈতিক সত্য হল, মানুষের মূল প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে গ্রাম বা কৃষিক্ষেত্র আর বাজারব্যবস্থার কেন্দ্রিকরণে তাকে আত্মসাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠে শহরসভ্যতার শিল্পোৎপাদন, পরিষেবা, ও নির্মাণ শিল্প। অধিকাংশ মানুষ আজ যে শহরবাসী, এটা কেন্দ্রিকরণেরই এক ফসল। কেন্দ্রিকরণ থেকে ক্রমাগত আরও কেন্দ্রিকরণ। এর যেন শেষ নেই।
গত শতাব্দীর নব্বই দশক থেকে এসে পড়ল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আর বিশ্বায়ন (economic globalisation)। আর্থিক সম্পদের হিসাবে যে যত নগণ্যই হই না কেন, সকলেই বাঁধা পড়লাম বিশ্বব্যাপী এক অদৃশ্য বাজারের আন্তর্জালে। জীবন-জীবিকা বা রুটি-রুজির সংস্থান, সবই যেন অদৃশ্য বাজিকরের হাতে পুতুল নাচের মতো বাঁধা। কেন্দ্রিকরণ যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া তা নয়। স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাকপরিচ্ছদ, আচারব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি ভাবনাচিন্তাও একই শহরসভ্যতার ছাঁচে ঢালাই হয়ে চলেছে। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে হাজারে হাজারে আদিবাসী জনজাতি, স্থানীয় ভাষা, খাদ্য, জীবিকা, পেশা, ধর্ম, উৎসব, পরব, সংস্কৃতি নিয়ে মানবসভ্যতার যাবতীয় বৈচিত্র্য। সেইসঙ্গে ভেঙে গেছে স্বনির্ভর স্থানীয় আর্থব্যবস্থা বা লোকাল ইকনমিগুলো (destroying local economy)।
কেন্দ্রিকরণের নিয়মটাই যে তাই—সকলকে একই ছাঁচে ঢালাই করে একই সুতোয় গেঁথে আত্মসাৎ করা। তবেই না বাজার বাড়বে, অর্থনৈতিক চক্রটা (monetary circuit) ক্রমাগত ফুলেফেঁপে নিয়ে আসবে আরও বৃদ্ধি–-এই চক্রের আন্তর্জালেই ঘটতে থাকবে যাবতীয় আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, পুঁজি, ও বিনিয়োগ। স্বনির্ভর হয়ে স্থানীয় আর্থব্যবস্থাগুলো নিজস্ব পণ্য উৎপাদন, বিনিময়, আর কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে এর বাইরে থাকলে তো চলবে না। আত্মসাৎ করে বেড়ে ওঠাই কেন্দ্রিকরণ। টাকাপয়সা জমিয়ে বালিশ বিছানার নিচে রেখে নিশ্চিন্ত সুখে নিদ্রা দেবেন সে হতে দেওয়া যাবে না। এমনটা হলে আপনার ওই টাকা তো আর্থিক চক্রটার বাইরে চলে গেল। তা হবে না, সব টাকা ব্যাংকেই জমা পড়তে হবে –– ডিমানিটাইজেশনের (demonetisation) আসল উদ্দেশ্যটাই ছিল তাই ।
ডিজিটাল ইকনমির (digital economy) পথে টাকাপয়সার মারফত কেনাবেচা প্রায় উঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত (cashless economy) এই ব্যাপারটাকে আরও স্পষ্ট করেছে। আপনার আমার যাবতীয় আয়, ব্যয়, সঞ্চয়কে ডিজিটাল, মানে ব্যাংকের মারফৎ হতে হবে। আপনার আমার একক আয়, ব্যয়, সঞ্চয় যত নগণ্যই হোক, বিন্দু বিন্দু জলেই হয় যে সাগর। তাই যাবতীয় অর্থকে প্রতি মুহূর্তের জন্যেও ব্যাংকে, মানে আর্থিক চক্রের খাতাতে থেকে যেতে হবে আর তাকেই ব্যাংক থেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বিশ্বপুঁজিতে (global financial markets) লগ্নি করে কর্পোরেট ব্যবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধি ও মুনাফা আসবে।
মোড় ঘোরার সঙ্কট
পৃথিবী তো অসীম নয়। একমুখি কোনো প্রক্রিয়াই তাই চিরকাল চলতে পারে না। চূড়ান্ত পর্যায় এসে সে নানাভাবে নানাদিক থেকে সঙ্কটে পড়ে। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা হয়ত কেন্দ্রিকরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের এই সঙ্কটের দোরগোড়ায়। গত কয়েক দশক ধরে তারই ইঙ্গিত মিলছিল ক্রমাগত বেড়ে চলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অর্থনৈতিক সঙ্কটে। এমন আশঙ্কাও কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন যে, মানুষেরই অবিমৃশ্যকারী কর্মকাণ্ডে এবার ষষ্ঠবার পৃথিবী থেকে জীবজগৎ বিলুপ্ত হতে চলেছে (the sixth extinction)। এর আগের পাঁচবারের বিলুপ্তির কারণ ছিল নিতান্তই প্রাকৃতিক (রিচার্ড লীকি ও রজার লেউইন, ১৯৯৫, দ্য সিক্সথ এক্সটিংশন)।
মানুষের কর্মকাণ্ডে শহরসভ্যতার অস্বাভাবিক স্ফীতির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। ক্রমাগত ধ্বংস হয়েছে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, আর প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগতের বৈচিত্র্য। এমনিতেই সারা বিশ্বে বিপুল জনসংখ্যা ও জনঘনত্বের অতিকায় শহরগুলোকে পরিষেবাসহ বাঁচিয়ে মানুষের বসবাসের যোগ্য করে রাখাই সমস্যা হয়ে উঠছে––পরিবেশ দূষণ আর জলসংকট বেড়েই চলেছে। তার ওপর গত শতাব্দী থেকে এতকাল অজানা একের পর এক ভাইরাস ও ড্রাগ রেজিস্টেন্ট ব্যাকটেরিয়ারা নতুন নতুন রূপে এসে বার বার সৃষ্টি করছে মহামারী থেকে অতিমারী, যার আঘাত পড়েছে মূলত শহরবাসীর ওপর। সম্প্রতি ২০২০ সালে বিশ্ব জুড়ে করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের অতিমারী ও তার প্রতিরোধকল্পে দেশে দেশে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের লকডাউন সৃষ্টি করেছে এক সার্বিক সঙ্কট, যা শহরবাসীর জীবনযাপনের প্রায় প্রতিটা দিককেই বিপর্যস্ত করেছে, নিয়ে এসেছে এক অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
এই অতিমারীর প্রকোপের কয়েকটা বিশেষত্ব লক্ষ করার মতো। এক, আবির্ভাব চীনের উহান অঞ্চলে হলেও রোগটা ছড়িয়েছে মূলত উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ও সেখান থেকে অন্যান্য দেশে। দুই, রোগের বিস্তার দেখা গেছে মূলত শহরাঞ্চলে, গ্রামাঞ্চলে নয়। তিন, শহরাঞ্চলেও প্রকোপ দেখা গেছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের আবাসন বা বহুতল ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে। গরীব মানুষের ঘন বসতিতে রোগ ছড়ালেও প্রকোপ তেমন দেখা যায়নি। চার, ইউরোপ, আমেরিকার উচ্চ আয়ের দেশে এই রোগে মৃত্যুর হার নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। পাঁচ, মেদজনিত স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ইত্যাদি নিয়ে শহুরে রোগগ্রস্তদের ক্ষেত্রেই করোনার প্রকোপ বেশি। ছয়, কোভিড-১৯ ভাইরাস ক্রমাগত নিজেকে পরিবর্তন করে রূপ বদলাচ্ছে। ভবিষ্যতে সে কী রূপ নেবে বা অন্য কোনও ভাইরাস যে আরেক অতিমারী আনবে না, তা বলা যাচ্ছে না।
এই বিশেষত্বগুলো থেকে এক কথায় বলা চলে, এ হল শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিশ্বায়নের রোগ––যেখানে উন্নয়ন সেখানেই এর প্রকোপ। এই রোগে সারা পৃথিবী জুড়ে মরছে ঠাণ্ডা ঘরে বসে কোক, পিৎজা, বার্গার, চিপস, ইত্যাদি ফাস্ট ফুড খাওয়া মেদবহুল শহুরে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা। তারাই আসল হটস্পট, মাঠেঘাটে রোদেজলে খেটে খাওয়া গরিব মানুষেরা নয়। গরিব মানুষদের এই রোগ কবে হচ্ছে আর কবে আপনি সেরে যাচ্ছে তাদের সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার জোরে (ভিটামিন ডি-য়ের ভূমিকা হয়তো) তা আমরা জানিইনা, কারণ এরা তো শহরের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতাতেই নেই । অবশ্য উন্নত দেশের শহরাঞ্চলের গরীব মানুষদের মধ্যেও করোনার প্রকোপ দেখা গেছে। তার কারণ হয়তো এটাই যে এদের খেতে হয় মূলত বরফে জমানো আর খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের প্রক্রিয়াজাত বাক্সবন্দী খাদ্য, যেমন ম্যাকডোনাল্ডস ইত্যাদি। রাসায়নিকহীন টাটকা শাক-সব্জি ইত্যাদি এদের কল্পনার অতীত।
মানবসভ্যতাকে আপাতত করোনা নিয়েই বাঁচতে হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি হল, মাস্ক পরে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, বারে বারে সাবান জলে হাত ধুয়ে, আর “সামাজিক দূরত্ব” বজায় রেখে চলা। তা সত্ত্বেও করোনাকে যে আটকানো যাবে সেটা নিশ্চিত নয়। তাই মাঝে মাঝেই শহরের এলাকায় বা কাজকর্মের ক্ষেত্রে লকডাউন হবে, যেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ করতে চলেছে করোনা অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায়। সব মিলে এটা স্পষ্ট যে শহরকেন্দ্রিক আর্থব্যবস্থা ক্রমাগত স্ফীত হয়ে এতকাল যে আর্থিক বৃদ্ধি এনেছে তা আর আগামী দিনে “সামাজিক দূরত্ব” ও লকডাউন নিয়ে সম্ভব হবে না।
এবার শহরসভ্যতার স্ফীতি ও মেদ ঝরার পালা। করোনা অতিমারীর প্রকোপ খানিকটা কমলেও আর্থব্যবস্থা আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। শিল্পোৎপাদন, নানাবিধ পরিষেবা, পরিকাঠামো নির্মাণ, আর্থিক পণ্যের লেনদেন, ও সেসব নিয়ে শহরবাজারের ব্যবসাবাণিজ্য, সবেতেই মন্দা ও ফলে কর্মসংস্থান প্রায় তলানিতে। একমাত্র ভরসা কৃষিক্ষেত্র। লকডাউনের ঠেলায় শহরের অসংগঠিত ক্ষেত্রের জীবিকা কর্মীরা (পরিযায়ী শ্রমিক?) অনেকেই যে যার গ্রামে ফিরে গেছেন। অবস্থা খানিকটা ঠিক হলে কেউ কেউ হয়ত ফিরে আসবেন শহরে জীবিকার খোঁজে। কিন্তু শহরে কি আর সেই আগের মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে? গ্রামকেই বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন এক অন্য আর্থব্যবস্থার বিকাশ, যা গড়ে উঠবে বিকেন্দ্রিক স্থানীয়করণের পথে কৃষিকেই মূল ভিত্তি করে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে মূল ভূমিকায় দেখা যায় ঘটনাচক্রে কোনও বিশেষ ঘটনা বা অবস্থার সৃষ্টি (চান্স ফ্যাক্টর) ও সেই থেকে তৈরি হওয়া সুদূরপ্রসারী প্রয়োজনসমূহ (নেসেসিটি ফ্যাক্টর), যা থেকে শুরু হয় নতুন পথে চলা। করোনা অতিমারী সম্ভবত এমনই এক চান্স ফ্যাক্টর, যা থেকে তৈরি হয়েছে অন্য পথে চলার প্রয়োজন (নেসেসিটি ফ্যাক্টর)। এর অর্থনীতির সন্ধান অবশ্য আধুনিক অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বকথায় মিলবে না।
অন্য পথের ভাবনা
মানবসভ্যতার বিকাশ, নির্মাণ, অগ্রগতি, যাই বলি না কেন, সবের পিছনে আছে উদ্বৃত্ত উৎপাদন। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন আসে কৃষি থেকে (role of surplus agriculture in economic development)। গত চারশ বছরের কেন্দ্রিকরণের অর্থনীতির ফলে একদিকে গ্রামকে ক্রমাগত উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করে শহরে চালান দিতে হয়েছে আর অন্যদিকে স্থানীয় আর্থব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে গ্রাম থেকে ক্রমাগত মানুষকে জীবিকার খোঁজে আসতে হয়েছে শহরে। একেই আত্মসাৎ করে শহরের শিল্পবাণিজ্য ও যাবতীয় কর্মকাণ্ড ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠেছে।
এই সহজ সত্য আধুনিক অর্থশাস্ত্রের চোখে দেখলে ধরা পড়বে না। তাই আমাদের ফিরে দেখতে হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী অর্থনীতিবিদদের (physiocrats) চোখে। এঁদের মূল কথা হল, শিল্পপণ্য, পরিষেবা ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্য আদৌ কোনও উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে না। প্রকৃত অর্থে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয় একমাত্র কৃষিক্ষেত্রে । শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা শুধু কম মূল্যে কিনে (অথবা বেশি মূল্যে বিক্রি করে, বা দুই-ই) মুনাফা লাভ করে, যা এক একটি স্তরের অর্থনৈতিক নির্মাণ মাত্র (economic construct of profits)। ফ্রান্সিস কেনে (Fancois Quesnay) তাঁর বিখ্যাত সার্কিট সারণিতে (১৭৫৮) (tableau economique) এটাই দেখিয়েছিলেন যে শিল্পপণ্য, পরিষেবা ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্যের এক একটি স্তরে মুনাফা লাভ দেখা গেলেও সার্বিকভাবে সমগ্র ব্যবস্থায় কোনও উদ্বৃত্ত বা লাভ থাকে না কারণ, এই বিনিময়ে যে ব্যক্তি কম মূল্যে বিক্রি করেছে (অথবা বেশি মূল্যে কিনেছে) তার ঠিক সমপরিমাণ লোকসান হয়। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত (Net product in Physiocracy) কোনও অর্থনৈতিক নির্মাণ নয়, তার উৎপাদন হয় প্রকৃতির নিয়মে (ওয়ে অভ নেচার)। তাই উচিত হল, প্রকৃতির নিয়মগুলি বুঝে কৃষিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মানুষের অর্থনৈতিক নির্মাণের (ওয়ে অভ ম্যান) চলা।
স্বভাবতই, কলকারখানার শিল্পোৎপাদন ও তাকে ঘিরে ব্যবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধি ও শহুরে আধুনিকতার বিকাশে মুগ্ধ ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদদরা এই ভাবনাকে কোনও আমলই দিতে চাননি। গত দেড়শ বছর ধরে শহুরে আধুনিকতার প্রতি মুগ্ধতার খেসারৎ আমরা দিয়ে চলেছি প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে এক বিষাক্ত পৃথিবীর জন্ম দিয়ে।
করোনা-আক্রান্ত শহরসভ্যতা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। কৃষিকেই মূল ভিত্তি করে এক অন্য আর্থব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দিলেও তা সহসা গড়ে উঠবে না। হঠাৎ একদিনে চারশ বছর ধরে গড়ে ওঠা আর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়ে না, তার বিকল্পও গড়ে ওঠে না। তাহলেও, পুরনোর ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই নতুনের সৃষ্টি, আবার নতুনের সৃষ্টি বিনা পুরনোর ধ্বংসও হয় না।
তাই অতি ক্ষুদ্র প্রয়াস হলেও আজকের প্রয়োজন অন্য অর্থনীতির সন্ধান ও বিকল্প আর্থব্যবস্থা নির্মাণের বীজ বপনের পথে চলা শুরু করা। এই অন্য অর্থনীতির পথ কেন্দ্রিকরণ নয় বিকেন্দ্রিকরণ, বিশ্বায়ন নয় স্থানীয়করণ। অদৃশ্য বাজারশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়া ‘বাজারের জন্য উৎপাদন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় প্রয়োজনের পণ্য উৎপাদন, বিনিময়, ও নিজেদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে স্থানীয় আর্থব্যবস্থাগুলোর গড়ে ওঠা এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের পারস্পরিক বিনিময় মিলিতভাবে জন্ম দেবে এক বিকল্প আর্থব্যবস্থার।
হয়তো এ অনেক দূর ভবিষ্যতের কল্পনা। তাহলেও প্রশ্ন জাগে, এক একটি স্থানীয় আর্থব্যবস্থার ভৌগোলিক পরিধি কীভাবে ঠিক হবে। এতকাল ইউরোপীয় “নেশন স্টেট”-এর ধারণা থেকে আমরা যাবতীয় বৈচিত্র্যকে দুরমুশ করে গড়তে চেয়েছি এক রাষ্ট্র, এক জাতি, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি (এক ধর্ম?)। রাজনীতির প্রয়োজনে রাজনৈতিক সীমানা নির্দিষ্ট করতে আমরা গণ্ডী টেনেছি রাষ্ট্রের, প্রদেশের, জেলার, মহকুমার, ব্লকের, পঞ্চায়েতের, গ্রামের। আর সে নিয়ে কাটাছেঁড়া ও জোড়া দেওয়া করেই চলেছি। এ ভাবে নয়, এক একটি গ্রামের মিলিত উদ্যোগ থেকে শুরু করে স্থানীয় আর্থব্যবস্থার পরিধি স্বাভাবিক ভাবেই নির্ধারিত হয়ে যাবে প্রাকৃতিক ও স্থানীয় জনজাতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে, যার কিছুটা প্রতিফলন হয়ত আজও মেলে জেলাগুলির ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক চিহ্নিতকরণে।
বিকল্প আর্থব্যবস্থার এই কল্পনায় অতিকায় শহর, যাবতীয় সম্পদ শোষণ করে যা কেবলই স্ফীত হয়, তার কোনও স্থান নেই, আছে আঞ্চলিক আর্থব্যবস্থাগুলোর সংযোগস্থলে যোগাযোগ, পণ্য বিনিময়, ও কারিগরি পণ্যের প্রয়োজনে ছোট ছোট গঞ্জ শহর। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বলতে যোগাযোগ, সেচ, জল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের পরিকাঠামো নির্মাণ, এবং আইন-শৃঙ্খলা, উচ্চতর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি পরিষেবার কথা ভাবা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় না থাকবে কর্পোরেট সংস্থা ও তার মালিক-শ্রমিক, না থাকবে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি; থাকবে উৎপাদক, কারিগর, পেশাদার, পরিষেবা কর্মী, ও নিজস্ব পুঁজির ব্যবসায়ীরা। এসবই কিছু আন্দাজ মাত্র।
সুদূরপ্রসারী এই কল্পনাকে আরও বেশিদূর বয়ে নিয়ে যাওয়া নিরর্থক, কারণ ভবিষ্যতের পথ ভবিষ্যৎই গড়ে নেয়। পরিকল্পনা করে তা গড়া যায় না। তাহলেও প্রশ্ন জাগে, কোন পথে শুরু হতে পারে আজকের সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প আর্থব্যবস্থার বীজ বপন ।
কৃষিকর্মের অভিমুখ
বর্তমান শহরকেন্দ্রিক সঙ্কটে একমাত্র ভরসা কৃষিক্ষেত্র (rural economy not the corporate sector))। শহরে আর সেই আগের মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, গ্রামকেই বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু তা আসবে কীভাবে? এতকালের কেন্দ্রিকরণে গ্রামীণ অর্থনীতির “পুল-পুশ ফ্যাক্টর” (push pull factors of migration) যে উল্টোটাই ঘটিয়ে এসেছে। শহরের চাকচিক্য ও বাড়তি রোজগারের সম্ভাবনা গ্রাম থেকে মানুষকে টেনে এনেছে শহরে শ্রমিক করে (পুল ফ্যাক্টর)। আবার কৃষিকাজে নতুন নতুন প্রকৌশল (টেকনোলজি) ও যন্ত্রের ব্যবহার, বিশেষত বড় জোতের খামারে, ক্রমাগত কর্মসংস্থান কমিয়ে জীবিকার খোঁজে মানুষকে ঠেলে দিয়েছে শহরে (পুশ ফ্যাক্টর)। একটা ফ্যাক্টর জন্ম দিয়েছে আরেকটার, সৃষ্টি হয়েছে এক দুষ্টচক্রের।
মজার কথা হল এই করেই কিন্তু শহর আরও বেড়ে ওঠে। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে চলে এলে গ্রামের উৎপাদিত খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়, যা চলে আসে শহরে। এদিকে গ্রামে থাকলে যে চাল হয়তো ২৫ টাকা কিলো দরে মিলত, গ্রাম থেকে আসা জীবিকা কর্মীকে সেই চালই কিনতে হয় শহরে এসে ৩৫ টাকায়। এই বাড়তিটা হল শহরবাজারের মাশুল, যা শুষে নিয়ে ফুলে ওঠে শহর। বড়, মাঝারি ও ছোটখাট জোতের কৃষিকাজ আজ পুরোপুরি শহরের বাজার-নির্ভর। বাজারে ফসল বিক্রি করে টাকা আয় করাই এর লক্ষ্য। যতদূর সম্ভব কম খরচে বেশি উৎপাদন করো — বাজারের এই নিয়মেই আসে নানাবিধ প্রকৌশলের উচ্চফলনশীল প্রজাতির বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, নলকূপ সেচের জল, আর ট্র্যাক্টর ইত্যাদি যন্ত্রের ব্যবহার।
এ পথে তো কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়েনা। এদিকে সাধারণ চাষি পড়ে যায় বাজারের টাকার চক্রে (farmers debt)। বাজার থেকে টাকা ঋণ নিয়ে বছর বছর চাষের এতসব উপকরণ কেনা, আর ফসল ফলিয়ে আবার সেই বাজারেই বিক্রি করে টাকা আয় করা — আশা এই যে ধারদেনা মিটিয়ে খেয়েপরে বাঁচার মতো কিছু টাকা রোজগার হবে। বাজারের এই টাকার চক্রে প্রতি বছর দেশে হাজারে হাজারে চাষি সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যা করে, ফসলের উপযুক্ত দাম না পেয়ে, ঋণ মেটাতে না পেরে। উপায় নেই তাই চাষিরা বাঁধা পড়ে আছে কৃষিকাজে। সরকারও তাঁদের এই পথেই থাকার আশা যোগায় নানাবিধ কৃষিঋণ, শস্যবীমা, ফসলের সরকারি সহায়ক মূল্য, ও কখনো হয়তোবা ঋণ মকুব প্রকল্প করে। কিন্তু কথায় যে আছে, আশায় মরে চাষা।
অগত্যা অনেকেই বাধ্য হচ্ছে বড় বড় কোম্পানির চুক্তিচাষে (contract farming)। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কোম্পানির চুক্তিচাষ (corporate farming) থেকেই মূলত শহরের বাজারের জন্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও চালান আসবে। বেশি দামের এই খাদ্যপণ্য উৎপাদন কিন্তু গ্রামের জন্য নয়। ভবিষ্যতে এর এক ভয়ানক পরিণতি হতে পারে — গ্রামেই খাদ্যপণ্যের অভাবজনিত দুর্ভিক্ষ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সমস্যা আরেক রকম। বাজার থেকে টাকা দিয়ে চাষের উপকরণ কেনার মতো টাকা অনেকেরই থাকে না। আবার, সে হলেও জমি ছোট বলে বাজারে ফসল বিক্রি করে তেমন আয়ের সম্ভাবনাও থাকে না। এদের অনেকেই তাই বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে অবস্থাপন্ন চাষির কাছে জমি বেচে বা ইজারা দিয়ে (আসলে বন্ধক) পরিণত হয় খেতমজুর বা শহরের দিনমজুরে (marginal farmers)। তাহলেও, একান্ত বাধ্য না হলে, এরা চেষ্টা করেন যা হোক ২-৪ বিঘা জমি পারিবারিক শ্রমে চাষের জন্য ধরে রেখে বছরের খাওয়ার চাল, মুড়ি, আলু উৎপাদন করে নিতে (family farming)। এই ধরনের পারিবারিক চাষে ফসল বিক্রির জন্য বাজার-নির্ভরতা না থাকলেও কিন্তু বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি কেনার জন্য টাকার দরকার ও বাজার-নির্ভরতা থেকেই যায়। আজকাল বাজারের চাষের বীজ, যা কোম্পানি বিক্রি করে, এমনই যে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি ছাড়া ফলন পাওয়াই দুষ্কর।
সম্প্রতি চল হয়েছে রাসায়নিক বা বিষমুক্ত জৈব চাষের (organic farming)। সে আরেক বিপদ। শহরের বাজারে জৈব খাদ্যপণ্য বেশ চড়া দামে বিকোয়। তাই দেখা যায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জৈব চাষে সংগঠিত করছেন বেশ কিছু সংগঠক সংস্থা। এই সংগঠকরা নানান জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে জৈব চাষের শংসাপত্র (organic farming certification) এনে অনুমোদিত চাষ পদ্ধতি বলে দেন ও সেই কাজে তাদের সংগঠনে চাষিদের নথিভুক্ত করান। এক একটা সংগঠনে হাজার খানেক চাষিকেও নথিভুক্ত হতে দেখা যায়। গ্রামে বিক্রি নয়, শংসাপত্রসহ উৎপাদিত পণ্য সংগঠকরা চড়া দামে বিক্রি করেন শহরের বাজারে ও তার থেকে চাষিদের টাকা দিয়ে থাকেন। শহরের বাজারের জন্য এ হল আরেকভাবে চুক্তিচাষ। এর ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা জৈব চাষের সংগঠনে এসে নিজের জমিতে নিজেই আসলে খেতমজুর হয়ে পড়েন। তথাকথিত এই জৈব চাষ পদ্ধতিগতভাবে প্রায় একই, শুধু রাসায়নিকের বদলে জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যার বেচাকেনার বাজারও তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু এই জৈবচাষের পথে শহরের বাজারমুখী উচ্চমূল্যের খাদ্যপণ্যের উৎপাদন অদূর ভবিষ্যতে ঢেকে আনবে সমূহ বিপদ — গ্রামের প্রান্তিক চাষি, খেতমজুর ও সাধারণ মানুষেরা পড়বে ভয়াবহ খাদ্যসংকটে (organic farming leads to economic disaster)।
কেন্দ্রিকরণের বিপরীত প্রক্রিয়ায় স্থানীয়করণের (Localisation) পথে স্থানীয় আর্থব্যবস্থার মূল কথাটাই হল অদৃশ্য বাজারশৃঙ্খলের আন্তর্জাল থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় প্রয়োজনে স্বনির্ভর পণ্য উৎপাদন ও স্থানীয়ভাবে পণ্য বিনিময়। বড় বা মাঝারি চাষি বা তথাকথিত জৈব চাষের সংগঠন এ পথে আসবে না, কারণ তাদের অস্তিত্বই হল ‘বাজারের জন্য উৎপাদন’। গ্রামে গ্রামে ছোট জমির ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা, যাঁরা পারিবারিক শ্রমে যতটা সম্ভব নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করে থাকেন, তাঁদের মিলিত সামাজিক উদ্যোগে, স্থানীয় কারিগরদের নিয়ে এ পথে চলা শুরু হতে পারে। এই মিলিত উদ্যোগই স্থির করবে, বাজারে বিক্রি নয়, নিজেদের প্রয়োজনে কে কোন ফসল বা পণ্য কতটা করবে ও কীভাবে বিনিময় করে নেবে।
স্থানীয় আর্থব্যবস্থার এক বিশেষ দিক হল নিজেদের প্রয়োজনের পণ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা। উৎপাদনের উপকরণ (যেমন বীজ, সার ইত্যাদি) পেতে বাজারের দ্বারস্থ হতে হলে সেই একই সমস্যা এসে পড়ে। সে সব কিনতে হাতে টাকা (বাজারের প্রচলিত মুদ্রা) নিয়ে যেতে হয়। সুতরাং, ওই বাজারেই কিছু না কিছু বিক্রি করে সেই টাকা রোজগার করতে হয়। ঘুরে ফিরে সেই বাজারের কেনাবেচার যাঁতাকলে পড়ে যেতে হয় । স্বনির্ভরতা নয়, এসে পড়ে বাজার-নির্ভরতা। স্বনির্ভরতার পথ হল, বাজার থেকে কিনতেই হবে এমন পণ্যের প্রয়োজনীয়তা পরিহার করে চলা। স্থানীয় আর্থব্যবস্থায় ফসল চাষের এই স্বনির্ভর পথ হল কোনও সার, কীটনাশক ও জমি কর্ষণ ছাড়াই শ্রমনিবিড় প্রাকৃতিক চাষ পদ্ধতি (ফুকোওয়াকা) ও তার জন্য অতি অবশ্যই স্থানীয় প্রজাতির বীজ সংরক্ষণ। স্থানীয় আর্থব্যবস্থার উৎপাদকরা নিজেদের মধ্যে পণ্য বিনিময় করবে। আবার একটি স্থানীয় আর্থব্যবস্থা তার উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিনিময় করতে পারে অন্য একটি স্থানীয় আর্থব্যবস্থার সাথে।
প্রশ্ন হল, এই বিনিময় হবে কী হিসাবে বা কীভাবে। বাজারের প্রচলিত মুদ্রা বা টাকা দিয়ে তো এই কাজ হবে না, কারণ এই মুদ্রা দিয়ে বেচাকেনা মানে সেই বাজারের সাথেই যুক্ত হয়ে পড়া। নিজেদের মধ্যে বিনিময়ের সুবিধার জন্য স্থানীয় আর্থব্যবস্থাকে তার নিজস্ব কোনও বিনিময় মাধ্যম বা “কমিউনিটি মানি” (community money)বা হিসাব রাখার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিশ্বায়িত বাজারশৃঙ্খল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে স্থানীয় প্রয়োজনে উৎপাদন, বিনিময় ও বিনিময় মাধ্যমের ব্যবহার কোনও সুদূরপ্রসারী কল্পনা নয়। ইতোমধ্যেই কিছু দেশের কোথাও কোথাও লোকাল প্রোডাকশন (local prodution for local consumption), লোকাল এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং সিস্টেম (local exchange trading system), ও কমিউনিটি মানির আবির্ভাব ঘটেছে। চারশ বছরের কেন্দ্রিকরণে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ানো মানবসভ্যতাকে হয়ত আবার এই পথেই যেতে হবে। এ কোনও নতুন পথ নয়। এটাই ছিল সভ্যতার আদিকাল থেকে আর্থব্যবস্থার যাত্রা শুরুর পথ।
Reprint: pagefournews.com, 13-15 October, 2020
You May Also Like

তথ্যে ভারাক্রান্ত মানুষ
January 22, 2022