বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র — শিক্ষণ পদ্ধতির রূপরেখা

বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র (vidyacharcha kendra) ব্যাপারটা যে কবে কী করে শুরু হয়ে গেল তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কোনও পূর্বপরিকল্পনা আদৌ ছিল না। ‘বিদ্যাচর্চা’ নামটাও প্রায় আপনিই এসে গেছে বিশেষ ভাবনাচিন্তা ছাড়াই। এ যেন চলতে চলতেই চলার পথ তৈরি হয়ে যাওয়া। এই চলার পথে গত ছয়-সাত বছর পার করে আজ ২০২১ সালে এসে দেখি, কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন হয়নি, নানা জনের নিজস্ব উদ্যোগেই পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৫০টা গ্রামে বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র চলছে মোটামুটি ১০০০ শিশুর হাতেখড়ি থেকে ইস্কুলের প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া শেখার কাজে। বিদ্যাচর্চার এই ব্যবস্থা ইস্কুল শিক্ষার বিকল্প নয়, সহায়ক। এর দরকার হল, কারণ আজকাল ইস্কুলের পড়া শুধু মুখস্তই হয়, লেখাপড়াটা তেমন আর শেখা হয় না। শিশুশিক্ষার সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলো তো তাই বলে। দেখা গেছে, ইস্কুল ব্যবস্থায় শিশুশিক্ষার মহাযজ্ঞ চলেছে, তবুও সাধারণ যোগ-বিয়োগই করতে শেখেনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বহু শিশু (annual status of education report 2019)। ‘বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র’ (vidyacharcha kendra) নামটা বেশ গুরুগম্ভীর শোনালেও ব্যাপারটার শুরু কিন্তু খুবই সহজ সাধারণ। এক একটা গ্রামে ১৫-২০ জন করে শিশুকে নিয়ে একসাথে বসে (মণ্ডলী প্রথা) গ্রামেরই এক একজন দিদিমণি লেখাপড়া শেখার চর্চা করছেন তাঁরই বাড়ির আঙিনায়, দিনে মোটামুটি দুই ঘণ্টা করে। এখানে নেই শিশুশিক্ষার নামে কোনও মহৎ যজ্ঞের আয়োজন — না আছে ইট কাঠ পাথরের ইস্কুল বাড়ি নামক প্রতিষ্ঠান ও তার চেয়ার টেবিল বেঞ্চি ব্ল্যাকবোর্ড, না আছে ‘মাস্টার’ আর শিশুদের শ্রেণি বা ক্লাসে ক্লাসে ভাগ করে বছর ধরে ও প্রতিদিন ঘণ্টা ধরে এক একটা পাঠ পড়ার একই নির্দেশ সকলকে দিয়ে দেওয়া, না আছে শিশুর পিঠে ব্যাগ ভর্তি বিশালাকার রঙবেরঙের বই আর খাতার বোঝা, না আছে ইস্কুলের জামা জুতোর ইউনিফর্ম আর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার নানান বিধিনিষেধ। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে আছে মূল লক্ষ্যটাকেই সামনে রাখা, যাতে এতসব উপলক্ষ্যের ভিড়ে আসল লক্ষ্যটাই যেন না-যায় হারিয়ে। তাই বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের পাঠ সংকলনগুলিতে যাবতীয় মেদবাহুল্য বাদ দিয়ে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে — নির্দেশ নয়, নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে —শিশুরা ধাপে ধাপে ঠিক কী কী শিখবে, কতটা শিখবে, ও কীভাবে শিখবে। এই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে একেবারে প্রাক্-প্রাথমিকের হাতেখড়ি থেকে শুরু করে ইস্কুলের প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা, অঙ্ক ও ইংরেজির পাঠ সংকলনের ছোট ছোট পুস্তিকা, যা শিশুহাতে নাড়াচাড়ার উপযোগী ও তাই তার কাছে ভীতিপ্রদও নয়। শেখার জন্য প্রত্যেক শিশুর হাতেই এই পুস্তিকা দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির পাঠ্য, ‘আমার বই’ হল বড়সড় আকারের ৫২৪ পৃষ্ঠার একটি পুস্তক (এ ছাড়াও আছে স্বাস্থ্য ও শারীরশিক্ষা, ৬০ পৃষ্ঠা, ও সহজ পাঠ, ৭৯ পৃষ্ঠা)। এসবই নাকি ৬ বছরের শিশু এক বছর বরাদ্দ সময়ে (বড়জোর ১৮০ দিনে) পড়ে শিখে ফেলবে! আর এই পঠনপাঠনটি করিয়ে দেবেন সরকার নিযুক্ত উপযুক্ত শিক্ষণপ্রাপ্ত (ডি ইএল এড) কিন্তু গ্রামের ‘বহিরাগত’ শিক্ষক-শিক্ষিকারা। স্বভাবতই এই পঠনপাঠন চলে ঘণ্টা ধরে, টেবিল চেয়ারে বসা শিক্ষক-শিক্ষিকার বই থেকে পড়ে বা বোর্ডে লিখে দেওয়া নির্দেশকে ভিত্তি করে। এক একটি শ্রেণিকক্ষে একদল শিশুকে সার বেঁধে বসিয়ে সকলকে একই নির্দেশমূলক শিক্ষাদানের প্রথাগত ইস্কুল ব্যাপারটা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে লেখাপড়া করিয়ে দেওয়ার কারখানা। এখানে কারখানার পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মতোই চলে শিশুদের ওপর লেখাপড়া ঘষামাজা করার প্রক্রিয়া (batch processing in school education) — এক এক বছরে (এর নাম অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার) এক একটা শ্রেণির ঘষামাজা প্রক্রিয়ার শেষে শিশুর প্রবেশ ঘটে পরবর্তী শ্রেণিতে। স্কুল শিক্ষায় আছে এমন ১২টা শ্রেণি (৬ থেকে ১৭ বছর বয়েস)। কারখানার পণ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো এখানেও কিছু পণ্য বাতিল হয় ঠিকঠাক না হওয়ার কারণে। এখানে এর নাম ড্রপ আউট, যদিও মিড-ডে মিল দেওয়া আর পাশ-ফেল প্রথা না-থাকার ফলে উচ্চ-প্রাথমিক স্তর (অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত স্কুল ড্রপ আউট কমানো গেছে অনেকটা। কিন্তু তারপরেই প্রতি পাঁচজনের একজনকে ড্রপ আউট হতে দেখা যায়। শিশুশিক্ষার এই কারখানায় শিশুর বোঝা বা শেখা নয়, শিক্ষাদান মানে পাঠ্যপুস্তকের পাঠগুলো ধরে পড়িয়ে দেওয়া। কোন্ শিশু কতটা শিখল বা শিখল না, কে একটু এগিয়ে বা কে একটু পিছিয়ে, সেসব দেখার অবকাশ এখানে নেই। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিক্ষণ পদ্ধতিটা অন্য (learner centered approach)। এখানে শিক্ষক-শিক্ষিকা তথা ‘মাস্টারের’ নির্দেশ নয়, দিদিমণি ও শিশুরা একসাথে গোল হয়ে বসে চর্চার মাধ্যমে পাঠগুলো বোঝে, শেখে ও বারংবার অনুশীলন করে। শিশুদের কাছে আপনজন হিসাবে পরিচিত গ্রামেরই কোনও অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানা মহিলা, মা-মাসি বা দিদির মতো যত্ন করে, পাশে বসে লেখাপড়া শেখান। এই দিদিমণিদের নিজেদেরও অনেকটাই শিখে নিতে হয় — পর পর ধাপে ধাপে শিশুদের কী শেখাব, কীভাবে শেখাব। শিশুর লেখাপড়ার সাথে সাথে এটা দিদিমণিদেরও চর্চা (community education) । তাই বিদ্যাচর্চার মূল কথাটাই হল — আমরাই শিখি, আমরাই শেখাই। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের পাঠ সংকলনগুলি তৈরি করা হয়েছে এই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে যাতে গ্রামের মা-মাসিরা পারেন তাঁদের শিশুদের প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়াটা শিখিয়ে দিতে। এর একটাই লক্ষ্য শেখা, ইস্কুলের বই ধরে পড়া তৈরি করিয়ে দেওয়ার ‘প্রাইভেট কোচিং’ নয়। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে ইস্কুলের মতো বছর ধরে ক্লাসে ভাগ করার ব্যাপারটা নেই। কোন্ শিশু কতটা শিখেছে ও পারছে মূলত তাকেই ভিত্তি করে, সাধারণত ৩ থেকে ৭ বছরের শিশুদের (ইস্কুলের প্রাক্-প্রাথমিক থেকে প্রথম শ্রেণি) একত্রে নিয়ে একজন ও ৭ থেকে ১১ বছরের শিশুদের (ইস্কুলের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) একত্রে নিয়ে বিদ্যাচর্চায় বসেন আরেকজন দিদিমণি। এখানে সব শিশুকে যে বই খুলে একই পাঠ পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয় তাও নয়। যারা যে পাঠটা পড়ে রপ্ত করে ফেলেছে তাদেরকে পরের পাঠ বুঝিয়ে দিয়ে অনুশীলনে রপ্ত করতে দেওয়া হয়। আর যাদের যে পাঠটা রপ্ত করতে আরও একটু সময় লাগবে তাদের সে সময়টা দিয়ে আরও একটু অভ্যেস করানো হয়। অর্থাৎ, যে এগোতে পারে তাকে এগোতে দেওয়া হয়, আর যার এখনও রপ্ত হয়নি তাকে সাহায্য করা হয় আরও সময় দিয়ে রপ্ত করতে। এই কাজটা গোল হয়ে ১৫-২০ জন শিশুর মাঝে বসা দিদিমণির করা সম্ভব, যা ইস্কুল নামের কারখানায় করা যায় না। এখানে ইস্কুলের মতো এক বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পাঠগুলো যে করে হোক পড়িয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই। ৩ থেকে ৭ বছর শিশুদের যার যখন সবগুলো পাঠ মোটামুটি শেখা হয়ে যায়, তাকে উন্নীত করা হয় পরবর্তী প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠে। এরও কোনও নির্ধারিত সময় বা সংখ্যা নেই। সময়ে সময়ে দু-চারজন করে শিশু যেমন প্রাক্-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরে উন্নীত হয়, তেমনই আরও নতুন শিশু এসে যোগ দেয় প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে। এক নিরবচ্ছিন্ন স্রোতে গ্রামের শিশুদের বিদ্যাচর্চা চলে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরে। শিশুরা শেখার বিশেষ বিশেষ দিকগুলো ঠিক ভাবে রপ্ত করেছে কিনা ও ধাপে ধাপে কতটা শিখেছে, তা যাচাই করার একটি রূপরেখাও তৈরি করা গেছে। বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিক্ষণ পদ্ধতির রূপরেখা ও এই পাঠ সংকলনগুলি তৈরি হয়েছে গত ৬-৭ বছরে প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী শিশুর লেখাপড়ায় সহায়তা করার পথে চলতে গিয়ে বারংবার হোঁচট খেয়ে। প্রথাগত ইস্কুলের শহুরে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষণ পদ্ধতি দিয়েই প্রথমে চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বোঝা গেল, ও পথে শিশুশিক্ষার মহাযজ্ঞ চলতে পারে। সেখানে শিশুরা হয়ত পড়ে অনেক, কিন্তু তার শেখায় পড়ে ফাঁকি। 30 May 2021, Phuldanga, Birbhum |
You May Also Like

ফিরে দেখা — বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের শিশুশিক্ষা ভাবনার আঁতুড় ঘর
January 12, 2022
সার্ধশতবর্ষের বিস্মৃত অতীত— বাংলার শিক্ষা
January 12, 2022